অগ্নি বললেন, “কোথাও ঘুরতে যাবি মা? কতদিন কোথাও যাওয়া হয় না।”
জিনিয়া বলল, “কোথায় যাবে বলো?”
মালতী অবাক হয়ে অগ্নির দিকে তাকালেন।
অগ্নি বললেন, “পাহাড়ে যাবি? সিকিম? দাস আছে, বললেই টিকিট কেটে দেবে।”
জিনিয়া বলল, “তোমরা যা ঠিক করবে। মা, রুনুমাসিকেও খবর দিয়ে দাও। কোন ছেলে দেখতে আসবে বলছিলে না? আসতে বলে দাও।”
অগ্নি ভ্রূ কুঁচকালেন, “কী হয়েছে তোর? হঠাৎ করে এই ডিসিশনগুলো নিতে শুরু করলি আবার?”
জিনিয়া বলল, “তোমরা সারাক্ষণ বলছ না মুভ অন করতে? মুভ অন করি। তোমরা যদি তাতে খুশি হও, তাহলে তাই হোক।”
কথাটা বলে জিনিয়া উঠে ঘরে চলে গেল।
মালতী উত্তেজিত ভাবে চাপা গলায় অগ্নিকে বললেন, “আমি রুনুকে ফোন করে দি? এখন রাজি হয়েছে, কখন আবার অন্য কথা বলবে কোনও ঠিক নেই তো!”
অগ্নি গম্ভীর মুখে বললেন, “কোথাও কাউকে ফোন করতে হবে না। কাল সকাল অবধি দেখি। ও যদি তারপরেও বলে, তখন গিয়ে ফোন করবে। এই মুহূর্তে ওর মনের মধ্যে দুটো সত্তা কাজ করছে। একটা সত্তা সৌপ্তিকের স্মৃতি আঁকড়ে বেঁচে থাকতে চাইছে, আর-একটা সত্তা মুভ অন করতে চাইছে। প্রচণ্ড দ্বিধায় পড়ে গেছে মেয়েটা। ওকে এখন কোনওরকম জোর করবে না।”
মালতী বললেন, “তোমার রিটায়ারমেন্ট এগিয়ে আসছে…”
অগ্নি বললেন, “তো কী হয়েছে? রিটায়ারমেন্ট এগিয়ে আসছে তো কী হয়েছে? মেয়ে সেলফ ডিপেনডেন্ট, আমার পেনশন থাকবে, কী অসুবিধা আছে? এসব ভিক্টোরিয়ান মেন্টালিটি ছেড়ে বেরোনোর চেষ্টা করো।”
মালতী কাঁদো কাঁদো গলায় বললেন, “আমার হয়েছে জ্বালা। মেয়ের বাবা, মেয়ে সবার কাছে মুখঝামটা খেয়ে বেড়াই। আমি আর কী করব?”
অগ্নি বললেন, “অনেক কিছু করার আছে। মেয়ে যেগুলো খেতে পছন্দ করে সেগুলো বানাও। আর দয়া করে মেয়ের মাথাটা বিয়ে বিয়ে করে খারাপ করে দিয়ো না। একটা মেয়ের বিয়ে করা ছাড়াও অনেক কাজ থাকে সেটা বোঝার চেষ্টা করো।”
মালতী বললেন, “রুনু যে ছেলেটাকে দেখেছে, তিন্নিদের মতো প্রাইভেট অফিসের ঝঞ্ঝাট নেই। স্কুলে পড়ায়, ভালো ছেলে। ফ্যামিলিতেও ওর মা ছাড়া কেউ নেই। এক ছেলে। এরকম ফ্যামিলি পাওয়া যাবে না। পরে একটা বাজে ছেলের সঙ্গে বিয়ে হবে, মেনে নিতে পারবে তো?”
অগ্নি বললেন, “বিয়েই হবে সেটা ধরে নিচ্ছ কেন? মেয়ে বিয়ে না করে ভালো থাকতে পারে না?”
মালতী রেগে গেলেন, “এমন অলুক্ষুনে কথা বলবে না কোনও দিন।”
অগ্নি বললেন, “অলুক্ষুনের কী আছে বুঝলাম না। পৃথিবীতে সবাইকে বিয়ে করে সংসার করতে হবে? কেউ কেউ নিজের মতো থাকতে পারবে না? বাবা-মার সঙ্গে কাটাল, এদিক সেদিক ঘুরল, ইচ্ছেমতো জীবন কাটাল, সম্ভব না?”
মালতী বললেন, “আর আমরা চোখ বুজলে? তখন কী হবে?”
অগ্নি বললেন, “জীবন কারও জন্য থেমে থাকে না। বিয়ে দিয়ে একটা আনহ্যাপি ম্যারেড লাইফে মেয়েটাকে ঠেলে দিয়ো না। শোনো আমার কথা। আরও কদিন অপেক্ষা করো।”
মালতী বললেন, “আমি তিন্নিকে এরকম দেখতে পারছি না আর। কষ্ট লাগছে।”
অগ্নি বললেন, “কষ্ট আমিও পাচ্ছি। কিন্তু মেনে নাও। এই সময়টা তাড়াহুড়ো করার না। অপেক্ষা করার। অপেক্ষা করো। সময় দাও মেয়েকে।”
মালতী রান্নাঘরে চলে গেলেন রাগ করে। তাঁর আর অগ্নির সঙ্গে কথা বলতে ইচ্ছা করছিল না।
১৩
সৌম্য বাবা-মার ব্যাগ গুছিয়ে দিচ্ছিল। আদিদেব টিভি দেখছেন অন্য ঘরে।
রোহিণী কেঁদে যাচ্ছিলেন। সৌম্য বলল, “কেন কাঁদছ মা? আমার ভালো লাগে তুমি এরকম করে কাঁদলে?”
রোহিণী বললেন, “সব ছেড়ে চলে যেতে হবে ভাবতেই কেমন লাগছে রে সমু। একটা দিন, জীবনটাই পালটে দিল।”
সৌম্য চুপ করে গেল। রোহিণী বলে চললেন, “শিয়ালদায় এক কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকতাম বিয়ে করে এসে অবধি। তোর বাবা এ জমি কিনল। বাড়ি করল। তোরা বড়ো হলি। কত কিছু জড়িয়ে আছে প্রতিটা ঘরের কোনায়। ভাবলেই যে কী কষ্ট হচ্ছে! আমরা ওখানে গেলে তোর অসুবিধা হবে না বাবা?”
সৌম্য বলল, “কেন অসুবিধা হবে মা? আমি তো সবসময়ে সবাইকে নিয়ে থাকতে চেয়েছি। এতদিন হয়নি। এবার হচ্ছে। আমি এতেই খুশি। আর কী চাওয়ার থাকে বলো? কেন এসব উলটোপালটা কথা ভাবো বলো তো?”
রোহিণী বললেন, “তা তো জানি বাবা। তুই আর সতু দুজনেই পাগলা গোছের বরাবর। তোদের মতো ছেলে কি সব বাবা-মার কপালে থাকে? তাও সতুটা…” রোহিণীর কথা আটকে গেল।
সৌম্যরও চোখে জল এসে গেছিল। রোহিণী যাতে না দেখেন, তাড়াতাড়ি সেটা মুছে নিয়ে বলল, “সব মালপত্র নেওয়ার প্রয়োজন নেই। আমরা তো কলকাতাতে আর আসব না, এমন নয়। মোটামুটি কাজ চালাবার মতো যা যা লাগে নিয়ে নিচ্ছি। মা দ্যাখো তো, এই শাড়িটা নেবে কি না?”
রোহিণী বললেন, “জিনিয়ার সঙ্গে তোকেও মানাত সমু। মেয়েটা বড্ড ভালো ছিল। সতুকে বড়ো ভালোবাসত।”
সৌম্য মার দিকে তাকিয়ে বলল, “এসব কী কথা বলছ মা? সতু যাকে ভালোবাসত তাকে আমি বিয়ে করতে যাব কেন? মাথাতেই এনো না এসব কথা। তা ছাড়া আমার বিয়ে করারই ইচ্ছে নেই এ জন্মে। এসব ইচ্ছে মাথাতেও এনো না।”
রোহিণী চোখ মুছে বললেন, “জানি তো, আমিও জানি এ চিন্তার কোনও মাথামুন্ডু নেই। কিন্তু মেয়েটার ওপরে কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে যেন। এসে চুপ করে সতুর ঘরে বসে থাকবে। সতু স্কুলে কী করত, ছোটোবেলায় কীভাবে সাইকেল থেকে পড়ে গেছিল, সব গল্প খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে শুনবে। এরকম ভালোবাসা আজকালকার দিনে কেউ বাসে বল তো?”