উপন্যাস সমগ্র ১
০. ভূমিকা / সূচিপত্র
ভূমিকা
লেখা শুরু করেছিলাম কবে? প্রায় পনেরো বছর হতে চলল।
সেমিস্টারগুলোর সময় যখন মাথায় চাপ পড়ত, স্ট্রেস রিলিজের জন্য হয়তো এক দেড় পাতা লিখে রাখতাম। গল্পগুলো শেষ হত না কোনোটাই। ভেবেছি, শেষ করব। হয়ে ওঠেনি। থার্ড ইয়ারের আগে যেমন ভাবিইনি। কোনও দিন, আমিও লিখব।
লেখা শুরু হয়েছিল অশোকনগরের এক কাগজের সম্পাদকের জোরাজুরিতে। নীলাদ্রি ভৌমিক তার নাম। আমি নীলাদ্রিমামা ডাকি। কেন জোর দিতেন জানি না। মূলত তাঁর কথাতেই লেখালেখির শুরু। লিটল ম্যাগ বেরোবে। লিখলাম একটা গল্প । উৎসাহ দিলেন বেশ কয়েকজন। বললেন ছোটোগল্পের চরিত্রেরা আমার লেখার মধ্যে প্রতীয়মান হচ্ছে।
উৎসাহ পেয়েই শুরু হল। এল আদরের নৌকা। কলেজ লাইফের সঙ্গে সমান্তরালভাবে আদরের নৌকা লিটল ম্যাগ চলত। প্রথম সংখ্যাতে তো বেশিরভাগই আমার গল্প। বন্ধুদের নামে। কে আনবে অত লেখা?
কলেজ পাস আউটের বছর বেরোল প্রথম গল্পের বই। নিজেই বের করলাম। সারাদিন প্রেসে বসে আছি। প্রুফ জিনিসটা কী, ম্যাগ করার আগে বুঝতামই না। পরে দেখলাম বইয়ের আসল জিনিস ওই প্রুফ। কত কত বানান ভুল যে হয়ে থাকে, বোঝা যায় না। এই ঠিক করলাম, আর-একবার প্রুফ দেখার সময় দেখা গেল আরও ভুল বেরোল।
বিরতি এল। ২০০৮-এর পর ছ-বছর পরে দ্বিতীয় বই। লেখায় ফিরতে শুরু করলাম। ২০১৬ থেকে শ্রীচরণেষু পেজে “অর্জুন” ছদ্মনামে জনপ্রিয়তা এল। বইমেলায় বইয়ের চাহিদাও এল।
পাঠক ভালোবাসলেন। ভালোবাসছেন।
আমার লেখালেখিও যেমন এই ভালোবাসা থেকেই আসে। নইলে অফিস করে এসে কি আর লেখার শক্তি থাকে? ওই ভালোবাসাটা আছে বলেই হয়তো। লড়াইটা করতে পারছি।
লিখতে পারছি।
আমার প্রথম উপন্যাস সমগ্র। বাড়ির বইয়ের আলমারিতে ছোটোবেলায় আমার প্রিয় লেখকদের উপন্যাস সমগ্র দেখেছি। আমার উপন্যাস সমগ্র প্রকাশ পাচ্ছে।
যেন কোনও স্বপ্ন দেখছি।
আশা করি পাঠক পছন্দ করবেন আমার লেখা।
ভালো থাকুন।
এই অভিশপ্ত বছর কোনও জাদুকাঠির ছোঁয়ায় সজীব হয়ে উঠুক, এই আশাটুকু করি।
ইতি
অভীক দত্ত
সূচিপত্র
- নীল কাগজের ফুল
- অন্তবিহীন
- অসময়ের বৃত্তান্ত
- শেষের পরে
নীল কাগজের ফুল
পর্ব ১
১
চাঁদ উঠেছে।
এরকম চাঁদ অনেক দিন পর উঠল। সুন্দর লাগছে দেখতে।
জানলা দিয়ে চাঁদের আলো এসে পড়ছে ঘরের ভিতর।
জিনিয়ার ঘরের জানলাটা বড়ো। চাঁদ দেখার জন্য আদর্শ। সে বিভোর হয়ে চাঁদ দেখছে। দু চোখ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে জল।
সৌপ্তিক চলে যাওয়ার এক মাস হয়ে গেল। তবু সে কিছুতেই সৌপ্তিককে ভুলতে পারছে না। কিছু কিছু জিনিস থাকে, যা সব মনে করিয়ে দেয়।
এই যেমন চাঁদ।
চাঁদ উঠলেই সৌপ্তিক মেসেজ করত, “চাঁদ দেখছ?”
জিনিয়া হয়তো তখন কোনও কাজ করছে। বিরক্ত হয়ে লিখত, “আমার কি অন্য কোনও কাজ নেই?”
সৌপ্তিক লিখত, “প্লিজ, একবার দেখে তারপর নাহয় কাজ করো।”
জিনিয়ার মনটা তখন খচখচ করতে শুরু করত। চাঁদ না দেখা অবধি শান্তি মিলত না।
এখন চাঁদই দেখছে সে। অথচ সৌপ্তিক নেই।
ট্রেন অ্যাক্সিডেন্টের খবরটা পাওয়ার পরেও বিশ্বাস হচ্ছিল না জিনিয়ার। বারবার সৌপ্তিকের মোবাইলে ফোন করে যাচ্ছিল। ফোনটা নট রিচেবল বলে যাচ্ছিল।
এখনও সৌপ্তিকের ফেসবুক প্রোফাইলটা আছে। থাকবে আজীবন।
জিনিয়ার ফার্স্ট সিন করা ছিল সৌপ্তিকের সব আপডেট। এখন কোনও আপডেট আসে না। কিচ্ছু আসে না। সব শেষ হয়ে গেছে।
মালতী এসে ঘরের আলো জ্বালালেন। ক্লান্ত মুখে তার খাটে বসে বললেন, “মশা মারার কয়েলটা তো দিবি। মশার কামড় খেতে ভাল্লাগে?”
জিনিয়া উত্তর দিল না।
মালতী একটু থমকে বললেন, “পৌলমী ফোন করেছিল। বলল একজন ভালো মনোবিদের সন্ধান পেয়েছে। যাবি?”
জিনিয়া বলল, “আমার মনোবিদের দরকার নেই। কিছুদিন সময় দরকার।”
মালতী বললেন, “সময় নিবি তো। অসুবিধা নেই। রুনু যে ছেলেটাকে আনবে বলছে, ওর সঙ্গে একটু কথা বলে নে কাল।”
জিনিয়া মার দিকে তাকিয়ে বলল, “পারো কী করে মা? ক্লান্তি লাগে না? কষ্ট হয় না একটুও আমার জন্য? সৌপ্তিককে তো তুমিও চিনতে! চিনতে না?”
মালতী থতোমতো খেয়ে বললেন, “তোর কথা ভেবেই বলি মা। গোটা জীবনটা একা কাটাবি তা তো হয় না। তা ছাড়া বাবার রিটায়ারমেন্ট…”
জিনিয়া বলল, “ব্রহ্মাস্ত্র বারবার ব্যবহার করতে নেই, জানো না? ঠিক সময়ের জন্য বাঁচিয়ে রাখতে হয়। মনে রাখবে তোমার ব্রহ্মাস্ত্র বাবার রিটায়ারমেন্ট। এটা বারবার বললে ভোঁতা হয়ে যাচ্ছে।”
মালতী দুঃখী মুখে বসে থেকে বললেন, “আমার আর ভালো লাগে না। আমি আর পারছি না বিশ্বাস কর। একটু শান্তি কি আমি পাব না?”
জিনিয়া বলল, “পাবে। আমি মরলে শান্তি পাবে। খুশি?”
মালতী কেঁদে ফেললেন, “কেন বারবার আমাকেই বলিস বল তো এসব? আমি কী করব? তুই ভালো থাকিস, আমি চাইতে পারি না?”
জিনিয়া বলল, “অবশ্যই চাইতে পারো। একশোবার চাইতে পারো। তোমার চাওয়ার বিরুদ্ধে আমি কিছু বলছি না। আমার শুধু একটাই কথা। আমার সময় চাই। দয়া করে সেটা দাও। এখনই সং সেজে ছেলেপক্ষের সামনে দাঁড়ালে নিজেকে বেশ্যা মনে হয়। বেশ্যা মানে খারাপ অর্থে বলছি না কিন্তু। ওই যে রাস্তায় লাইন দিয়ে দাঁড়ায়, নিজেকে সেরকম লাগবে সেটা বলছি।”