আমি ফিক ফিক করে হাসতে লাগলাম।
১১ জীমূতবাহন
ঘুম একটা শান্তির জিনিস। কিন্তু বউ ঠিক না থাকলে সে ঘুম শান্তির ছেলে হয়ে যায়।
ভোর চারটেয় আমার বউ আমাকে ঠেলতে শুরু করল।
আমি ঘুমচোখে ধড়মড় করে উঠে বসে বললাম, “কী হল?”
বউ বলল, “বাড়ি নিয়ে চলো। আমার গোছগাছ হয়ে গেছে।”
আমি হাঁ করে একবার ঘড়ির দিকে তাকালাম। আর-একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে বললাম, “এখন রাস্তায় বেরোলে কুকুরে তাড়া করবে তো। অন্তত দিনের আলো ফুটুক!”
বউ বলল, “না। তোমার বাইক আছে না?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
বউ বলল, “বাইক বের করো। আমাকে দিয়ে এসো। পরে লোক পাঠিয়ে সব বাক্স প্যাঁটরা নিয়ে যাব।”
আমি মাথা চুলকে বললাম, “আচ্ছা তাহলে বড়ো বাইরে সেরে নি।”
বউ বলল, “যা করবে তাড়াতাড়ি করো। আমার এখানে ঘুম হচ্ছে না।”
আমি উঠে বাথরুম গেলাম। অসময়ে বেগ আসে না। তবু চেষ্টাচরিত্তির করতে লাগলাম। সকালে ক্লিয়ার না হয়ে বেরোলে অস্বস্তি হয়।
অনেকক্ষণ চেষ্টার পরে আউটপুট বেরোবে বেরোবে করছে, এমন সময় বউ দরজা ধাক্কাতে শুরু করল, “হল?”
আমার আবার ভেতরে ঢুকে গেল। অনুষ্ঠান প্রচারে বিঘ্ন ঘটলে আমার ঢুকে যায়।
কিছুক্ষণ আরও বসে থেকে বিফলমনোরথ হয়ে বেরোলাম।
বউ গম্ভীর মুখে বলল, “ভেতরেই কি গোটা দিনটা কাটানোর প্ল্যান ছিল?”
আমি ব্যাজার মুখে তৈরি হয়ে ঘর থেকে বেরোলাম। নিচে নেমে বাবা মাকে জাগালাম। সবাই অবাক হয়ে বসে আছে। মা ঘুম জড়ানো গলায় বলল, “এত ভোরে অষ্টমঙ্গলা করতে যাচ্ছিস নাকি তুই?”
আমি বললাম, “না ওকে বাড়ি দিয়ে আসি। বাড়ি যেতে চাইছে।”
মা আর কোনও কথা না বলে শুয়ে পড়ল। যেন জানত এরকমই কিছু একটা হবে।
আমি বাইক বের করলাম।
বাড়ির সামনে পাড়ার কুকুরগুলো শুয়ে ছিল। ঘেউ ঘেউ শুরু করল। আমি বকাঝকা দিয়ে থামালাম।
গাড়ি স্টার্ট দিতে বউ এসে পেছনে বসল। ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ শ্বশুরবাড়ি পৌঁছোলাম। সেখানেও এক অবস্থা। সবাই ঘুমাচ্ছিল। বাইরের পাঁচিলের গেটে তালা দেওয়া। বউ বলল, “যাও, পাঁচিল চড়ে ভেতরে গিয়ে কলিং বেল বাজাও।”
আমি কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর মনে হল এই জিনিসের থেকে যত তাড়াতাড়ি বাঁচা যায়, ততই ভালো। পাঁচিল টপকে কলিং বেল বাজালাম। শ্বশুরমশাই দরজা খুলে আমার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে বললেন, “কী হল?”
বউ বাইরে থেকে চ্যাঁচ্যাল, “দরজা খোলো এত কথা না বলে।”
হতভম্ব মুখে শ্বশুরমশাই দরজা খুললেন।
বউ শ্বশুরমশাইকে বলল, “খুব ভেবেছিলে না? মেয়ে পার করে দিয়েছি? নাও চলে এসেছি। এবার কী করবে করো।”
শ্বশুরমশাই একবার মেয়ের দিকে আর একবার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “মানে?”
বউ বলল, “মানে পরিষ্কার। আমি চলে এলাম। রাতে ঘুমাইনি। এবার যাই, ঘরে গিয়ে ঘুমাই। ডিস্টার্ব করবে না দুটোর আগে।”
বলে গটগট করতে করতে বউ ঘরে চলে গেল।
শ্বশুরমশাই আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বললেন, “তুমি কিছু বলবে না?”
আমি বললাম, “আমি কী বলব? মানে আমার তো কিছু বলার নেই। আপনারা যে নাটকীয় পরিস্থিতিতে বিয়েটা দিলেন, তাতে এরকম হওয়াটা তো আশ্চর্যের কিছু নয়। হতেই পারে।”
শ্বশুরমশাই বললেন, “ওর মা ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমাচ্ছে। উঠে এসব দেখলে তো অক্কা পাবে। অষ্টমঙ্গলা হল না, এখনই মেয়ে বাড়ি ফিরে এল!”
আমি হাতের আংটি খুললাম, গলার চেন খুলে ওঁর সামনের টেবিলে রেখে বললাম, “এগুলো থাক। আর দরকার পড়বে না বোধহয়। আইনি ব্যাপার কিছু থাকলে আমরা আলোচনা করে পরে সেটল করে নেব। আপনার মেয়ে যদি না থাকতে চায়, তাহলে তো কিছু করার নেই।”
শ্বশুরমশাই ধরা গলায় বললেন, “আমি এই মেয়েকে নিয়ে কী করব? নিজেই বিয়ে ঠিক করল। সে বিয়ে ভেঙে গেল। ছেলে এলই না। তোমাকে কোনও মতে রাজি করিয়ে বিয়েতে বসালাম। তুই তখন বল বিয়ে করবি না! ছি ছি ছি, আত্মীয়স্বজন, পাড়াপড়শির কাছে মুখ দেখাব কেমন করে!”
আমি কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে চুপচাপ সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাইকে এসে বসলাম।
সকাল সকাল এত চাপ আর নিতে পারা যাচ্ছে না।
কোথাও গিয়ে ভালো চা খেতে হবে।
১২ অমৃত
প্রেম ভালো জিনিস।
চুমু খাবার পরে প্রেম ভালোতর জিনিস।
গরমের মধ্যেও মনে হয় চাদ্দিকে কেমন একটা ফুরফুরে হাওয়া দিচ্ছে, পাখি-টাখি গাইছে। খিঁচ ধরে থাকা লোকজনের মুখও মিষ্টি মনে হয়।
এই যে আমি খাবার টেবিলে বসে আছি দাদা আর বাবার সঙ্গে, আর বউদি ভাতের হাঁড়ি, মাছের বাটি সব দুম দুম করে টেবিলে দিচ্ছে, তবু সব কত মধুর লাগছে।
বাবা পরমহংসের মতো উদাসীন চোখে বসে আছে। দাদা ভয়ে ভয়ে বউদিকে দেখছে। অনন্যা খাবে বলে বউদি মাংস রেঁধেছিল, সে মাংসের বাটি কেমন অবহেলায়, করুণ ভাবে টেবিলের ওপর বসে আমাকে দেখছে।
এক ফাঁকে বউদি রান্নাঘরে যেতেই দাদা ফিসফিস করে বলল, “তোর কোনও দিন বুদ্ধি হবে না। অনন্যাকে কাটানো যেত, তা বলে লিপস্টিক মাখার কী দরকার ছিল?”
আমি দাদাকে বললাম, “আমি মাখিনি। চুমু খেয়েছে, আমি কী করব?”
দাদা হাঁ করে আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “মাইরি? সিরিয়াসলি? তুই প্রেম করছিস?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ।”
বাবা রান্নাঘরের দিকে আড়চোখে তাকিয়ে দাদাকে বলল, “সবাই তোর মতো মুখ গুঁজে পড়াশুনা করবে ভাবিস কী করে? তুই তোর মার মতো হয়েছিস। চিরকালের আনরোমান্টিক। অমুর মধ্যে আমি আমার ছায়া পাই।”