ভালোবাসা এত ভালো কেন?
দোকানি ডিম ফ্যাটাচ্ছে। চামচ দিয়ে কী অবলীলায় সে ডিম ফেটিয়ে যাচ্ছে।
আমার ভেতর থেকেই বেরিয়ে এল, “আমার জন্য একটা অমলেট দিয়ো তো।”
দোকানি অভ্যস্ত হাতে গ্লাসটা কড়াইতে খালি করে আর-একটা ডিম নিল। চামচ দিয়ে সেটা ফাটিয়ে গ্লাসে ঢেলে নুন লংকা দিল। আবার ফ্যাটানো শুরু। আমার পাশের জন মন দিয়ে অমলেট খাচ্ছেন। চামচ দিয়ে টেনে টেনে।
আমার মনে আছে আমাকে ক্লাস ফোরে শনিবার দুপুরবেলা যিনি অঙ্ক করাতে আসতেন, তাঁকে মা চায়ের সঙ্গে অমলেট দিতেন। স্যারের যেদিন মন ভালো থাকত, আমাকে তাঁর অমলেট থেকে কিছুটা দিতেন। যেদিন দিতেন, স্যারকে ভগবান মনে হত। যেদিন দিতেন না, ভারী কষ্ট পেতাম। মন খারাপ হত। সেদিন বিকেলে ভালো ব্যাট করতে পারতাম না।
ডিমের ভূমিকা আমার জীবনের অপরিসীম।
মেয়েটির পারফিউমের গন্ধ আমার হাতে লেগে রয়েছে। মাঝে মাঝেই আমি সে গন্ধ নিচ্ছিলাম। লিপস্টিকের গন্ধটাও যে কী ভালো লাগছিল! অমলেটের গন্ধের সঙ্গে মিলেমিশে সে গন্ধ এক অন্য জগতে নিয়ে যাচ্ছিল।
আমার অমলেট এল।
আমি মুগ্ধ চোখে সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। একজন ডিমের পোচের অর্ডার দিল।
দোকানিকে আমার দ্য ভিঞ্চি মনে হচ্ছিল।
কী সুন্দর কুসুমটাকে এক রেখে পোচ বানিয়ে দিল।
এসব প্রতিভা। সবার দ্বারা সম্ভব না। আমার অমলেট চামচ দিয়ে খেতে খেতেই আমি আমার জন্য পোচের অর্ডার দিয়ে দিলাম।
চুমুর সঙ্গে অমলেট না মিশলে সেটা ভালোবাসা হয় নাকি?
ধুস!
১০ অমৃত
দাদার বউ বা বউদিরা সাধারণত দু ধরনের হয়।
১) ভালো
২) খারাপ
এই ভালো খারাপের রিলেটিভ ব্যাপারও আছে। কেউ কেউ আছে, যতদিন ঠাকুরপো চাকরি পায়নি, ঠারেঠোরে কথা শোনাতে ছাড়বে না। আর যখনই সে ঠাকুরপো চাকরি পেয়ে যাবে, তখন সেই নয়নের মণি।
হাতের কাছে শাঁসালো ছেলে, নিজের আত্মীয়মহলে তখন ঘ্যাম বাড়াবার জন্য এই ঠাকুরপোই তখন কত ভালো। এটা সেটা রান্না আসছে। আর শুধু নিজের বউদি কেন, এই সময়টা যে কত মা-মাটি-মানুষের আবির্ভাব হয় সে লিস্টি শেষ হবার নয়।
সমস্যা হল চুমু এবং অমলেট খেয়ে আমি যখন বাড়ি পৌঁছোলাম তখন চুমুর দাগটা মোছা হয়নি।
বউদির পিসতুতো বোন অনন্যা আগে আমাকে বিশেষ পাত্তা-ফাত্তা দিত না। আমি সেভাবে লাইন মারতেও যাইনি, কিন্তু তেনার ধারণা ছিল আমার তার ওপর হেব্বি চাপ আছে। যদ্দিন চাকরি পাইনি পাত্তা না দেওয়াটা বজায় ছিল।
চাকরিটা পাবার পর থেকে অনন্যা প্রায়ই আসে। বউদির সঙ্গে কথা বলে, বউদি আকারে ইঙ্গিতে আমাকে আর অনন্যাকে জড়িয়ে কল্পনা চাওলা বানায়। আমি দাঁত-ফাত কেলিয়ে ঘরে ঢুকে পড়ি বা পাড়া বেড়াতে বেরিয়ে যাই। বউদিদের বাড়ি থেকে ফর্মাল প্রোপোজালও যে-কোনো সময় আসবে আসবে করছে, সকালেই শুনেছিলাম খাওয়ার টেবিলে বাবাকে বউদি ইনিয়েবিনিয়ে এ ব্যাপারে কিছু বলার চেষ্টা করছিল।
আমি অত কিছু বুঝিনি, হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ঢুকে অনন্যার সামনে পড়ে গেলাম।
বত্রিশ পাটি বের করে অনন্যাকে বলতে যাব “ভালো আছ?” দেখি অনন্যা কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে মুখে ওড়না দিয়ে বউদির ঘরে দৌড়ল।
আমি লিপস্টিকের দাগের কথা ভুলে গেছিলাম। অনন্যার দৌড় দেখে বুঝতে পারলাম সেটা দেখেই বিবিসি নিউজ নেটওয়ার্ক সক্রিয় হয়ে পড়েছে।
আমি সেটা আর না মুছেই ঘরে ঢুকে পড়লাম।
খানিকক্ষণ পরেই দরজায় ঠক ঠক। দরজা খুলে দেখি বউদি দাঁড়িয়ে আছে।
আমাকে দেখে বলল, “অমু, কিছু খাবে?”
বুঝতে পারছি বউদি এসব বলে আমার গাল দেখার তালে আছে।
আমি বললাম, “না বউদি, অমলেট খেয়ে এসেছি তো।”
বউদির চোখে পাওয়ার আছে। ভালো করে দেখতে পাচ্ছে না। কিন্তু বোঝাই যাচ্ছে যে লিপস্টিকের দাগ আইডেন্টিফাই করার ইচ্ছা বউদির ভয়াবহ। একটু দূরে অনন্যা কাঁদো কাঁদো মুখে দাঁড়িয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে রাহুল গান্ধিকে ভোটের রেজাল্ট শোনানো হচ্ছে।
আমি মোবাইলের টর্চটা জ্বেলে গালে আলো ফেলে বউদিকে বললাম, “দ্যাখো বউদি, আজকাল কী সব লিপস্টিক বেরিয়েছে শুনেছি, চুমু খেলেও গালে দাগ পড়ে না। তবু এ শেখেনি। ভালো দেখে একটা লিপস্টিক কিনে দিতে হবে বলো?”
বউদি চমকে গেল। আমাকে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, “কে? কাকে কিনে দিতে হবে লিপস্টিক?”
আমি বললাম, “সে আছে একজন। খুব ভালো মেয়ে। নিয়ে আসব। অনন্যারই বয়সি হবে। ভালোই হল। এ বাড়িতে একজন বন্ধু পাবে অনন্যা।”
বউদি কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে তাকিয়ে “অ” বলে ঘরের দিকে রওনা দিল।
কিছুক্ষণ পরে দেখলাম অনন্যাও ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেল। আমি ফেসওয়াশ দিয়ে মুখ-টুখ মুছে বসার ঘরে গিয়ে দেখি বাবা আমার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছে।
আমি বললাম, “কিছু বলবে?”
বাবা বলল, “বউমার কাছে শুনলাম তুই কোথায় কী করে এসেছিস নাকি?”
আমি বললাম, “সেরকম কিছু না।”
বাবা চারপাশ তাকিয়ে আমার দিকে তাকাল, গলা নামিয়ে বলল, “ভালো করেছিস। এই অনন্যা মেয়েটা মোটেও সুবিধের ছিল না। যারা মাংসে দু কেজি চিনি দেয় তারা মোটেও সুবিধার হয় না। বাঁচিয়েছিস। তা মেয়েটা কে রে?”
আমি বললাম, “ফেসবুকে আছে, অ্যাড করে নাও। বেশি প্রশ্ন করবে না। আমার প্রেস্টিজ আছে।”
বাবা মুখ বাঁকিয়ে বলল, “হুহ, আমার বয়ে গেছে অ্যাড করতে। তোর গোরু, তুই সামলা। আমি হলাম এখন শান্তি রক্ষা কমিটির মেম্বারের মতো। বাড়িতে ক্যাচাল দেখলে অর্ডার অর্ডার বলব।”