দশটায় “ফুলকো লুচি”, সাড়ে দশটায় “বিধবার কলঙ্ক” দেখে এক্কেবারে রাত এগারোটার সময় সবার খেয়াল হবে যে এবার খেতে হবে। তখন গিয়ে সবাই খেতে বসবে।
এদিন বাড়ি ঢুকে দেখি টোটাল বিলা চলছে।
বাবা গম্ভীর মুখে পায়চারি করছে। মা কাঁদো কাঁদো মুখে বসে আছে। আর বউ এইচবিও-তে কী একটা ইংরেজি সিনেমা দেখছে, তাতে যে-কোনো মুহূর্তে নায়ক নায়িক বিপজ্জনক দৃশ্যে অভিনয় করতে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারে। আমি ঢুকতে মা আমার দিকে এমন দৃষ্টিতে তাকাল যেভাবে সিনেমায় অভিমানী উকিল জজের দিকে তাকিয়ে বলে, “জজ সাহেব, আইনের চোখ তো অন্ধ, আপনিই এই অবিচারের বিচার করুন।”
আমার হাতে কালো প্যাকেট। আমি একবার বাবার দিকে, আর-একবার মায়ের দিকে তাকালাম। বউ কড়া গলায় বলল, “এনেছ?”
আমি মাথা নেড়ে প্যাকেটটা এগিয়ে দিলাম।
বউ ওদের সামনেই প্যাকেটটা বের করে দেখল। মা বড়ো বড়ো চোখ করে বউয়ের দিকে তাকাল। বাবা ঘরের বাইরে বেরিয়ে গেল।
বউ ভালো করে দেখে খুশি হয়ে বলল, “একদম ঠিক জিনিস এনেছ। বাহ। ভালো তো।”
আমি একবার মার দিকে তাকিয়েই উপরের ঘরে দৌড় দিলাম। এরকম বিপজ্জনক ফোর ফরটি ভোল্ট বউ হবে, আমি চারদিন আগেও জানতাম না মাইরি। কোথাকার কোন এক গ্রামের ঘোমটাপরা বলে আমার কতদিনের শখ, ফুলশয্যার সময় মাথায় ঘোমটা দিয়ে দুধ নিয়ে আসবে। তার জায়গায় কী চলে এল। ভাবতেই দেড়তলার ছাদ থেকে আত্মহত্যার ইচ্ছে করছে।
বউ সোজা উপরে চলে এসে আমাকে বলল “তোমার ফিরতে এত দেরী হল কেন?”
আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, “অমলকান্তির ফ্ল্যাটে গেছিলাম।”
বউ আমার আগাপাশতলা দেখে বলল, “তুমি কি পুরুষত্বহীনতায় ভোগো, স্বপ্নদোষ আছে, লিঙ্গ ছোটো? তাহলে ডিকে লোধের কাছে যাও।”
আমি গোবেচারার মতো বললাম, “কেন?”
বউ বলল, “যে ছেলে নিজের বিয়ের দিন পালায়, যার বিয়ে করার ধক নেই, সেই দুর্বল চরিত্রের ছেলের বাড়ি কী করতে গেছিলে? ঘর বন্ধ করে দেখতে যে তোমারটাও ওর মতো কি না?”
আমি ঘামতে শুরু করলাম। এ কী ডেঞ্জার চিজ রে ভাই! বলেও ভুল হয়েছে।
বউ ফ্যান চালিয়ে আমার সামনে চেয়ার নিয়ে বসে বলল, “তা কী বলল সে?”
আমি বললাম, “তোমাকে ফেরত চায়।”
বউ আমার পকেট থেকে সিগারেটের প্যাকেট আর লাইটার বের করে সিগারেট ধরিয়ে বলল, “ফেরত তো তখন চায় যখন জিনিস কারও পার্মানেন্টলি হয়। আমি ওর কোনও দিন পার্মানেন্টলি হইনি। হবার প্রশ্নই নেই। তুমি বিয়ে করতে গেলে কেন আমাকে? পালাওনি কেন?”
আমি বললাম, “আমি বুঝিনি। সবাই কী সব বলল, তুমি নাকি লগ্নজিতা হয়ে যাবে।”
বউ বলল, “লগ্নভ্রষ্টা। যাক গে, উদ্ধার করেছ। এবার ডিভোর্স দিতে হবে। সে ব্যাপারে কী করতে হবে দেখো।”
আমি আশার আলো দেখে বললাম, “রেজিস্ট্রিই হয়নি তো। ডিভোর্সের দরকার কী?”
বউ অনেকটা ধোঁয়া ছেড়ে বলল, “তাই তো! এটা তো ভেবে দেখিনি। তাহলে আবার কী! ডিল ফাইনাল। সকালে বাড়ি ছেড়ে দিয়ে আসবে। ওকে?”
আমি আশায় বাঁচে চাষার মতো মুখ করে বললাম, “একদম। যা বলবে।”
৯ অমৃত
পৃথিবীতে অনেক গন্ধ আছে। গোলাপের গন্ধ, রজনীগন্ধার গন্ধ, মুরগির গুয়ের গন্ধ, পেট্রোলের গন্ধ… কিন্তু আমার সবথেকে প্রিয় গন্ধ হল অমলেটের গন্ধ। কোনও জায়গা থেকে অমলেটের গন্ধ পেলেই আমার মনটা কেমন কেমন করে ওঠে। একটা ডিমের ক্ষমতা তুম ক্যা জানো রমেশবাবু!
অবশ্য রমেশবাবু ডিমের ব্যবসায়ী হলে জানতেই পারেন। সব না জানার দায় ভদ্রলোক নেবেনই বা কেন!
যাক গে, কথাটা কিন্তু আমি ডিম নিয়ে বলব বলে শুরু করিনি।
ইন ফ্যাক্ট, ডিম নিয়ে কিছু বলারই নেই।
ডিম্ভাত, ডিম্ভাজা ভালো, এই পর্যন্তই।
কথাটা অন্য।
কথাটা হল আমি প্রেমে পড়েছি।
এবং মারাত্মক প্রেমে পড়েছি।
মেয়েটির সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। আমার পাশে বসেছিল। আমরা আগে সোশ্যাল মিডিয়ায় কথা বলেছিলাম। মেয়েটির সঙ্গে শুধু দেখা হবার কথাই ছিল।
মাঝখান দিয়ে চুমু যে কখন চলে আসবে বুঝতে পারিনি।
আমি পাগলের মতো চুমু খেয়েছি তাকে। এবং সে আমাকে। প্রেমে পড়লে মানুষ ভুলে যায় চারপাশে কে আছে। আমারও তাই হয়েছিল। মেয়েটিরও।
চুমু খাওয়াখাওয়ির পর সে বেশ কিছুক্ষণ আমায় জড়িয়ে ধরে বসে রইল। আমি তাকে। বললাম, “ছাড়বে না?”
সে বলল, “ছাড়ব না।”
আমি বললাম, “এত ভালোবাসলে কবে?”
মেয়েটি আরও আঁকড়ে ধরে বলল, “জানি না।”
আমার বিভিন্ন অনুভূতি হচ্ছিল। সবথেকে বেশি ইচ্ছা করছিল লাফ মারতে। প্রেম জিনিসটা এত ভালো জানতাম না তো! এত ভালো একটা জিনিস আমি এতদিন করিনি কেন? কী ভালো লাগছে! মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। মনে হচ্ছে শহিদ মিনারের মাথায় উঠে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে সবাইকে জানান দি, “আমি ভালোবাসি। আমি তাকে পাগলের মতো ভালোবাসি।”
ভালোবাসায় শরীর এলেই সে ভালোবাসা খারাপ হয়ে যায় না। শরীর তো আসে স্বাভাবিক নিয়মে। আমি কাউকে ভালোবাসলে সে কাছে এলে আমি তাকে দূরে সরিয়ে দেব কেন? আর এই অনুভূতি কি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব?
সে বাসে করে চলে গেলে আমি রাস্তার পাশের দোকানে চুপ করে বসে থাকলাম। আমার চুল এলোমেলো হয়ে গেছে। গালে লিপস্টিকের দাগ। আশেপাশের লোক বেশ কৌতুক সহকারে দেখছে আমাকে। আমি তাদের পাত্তা না দিয়ে মন দিয়ে ডিমভাজার গন্ধ নিতে নিতে তার কথা ভাবতে লাগলাম।