কিন্তু একটু যে ঠান্ডা মাথায় শান্তিমতো বসে নবকুমারের কথা ভাবব, তার কি উপায় আছে? ওই বাবা দোকানের বাইরে থেকে “কপাল”, “কপাল” করে চেঁচাতে শুরু করে দিয়েছে। নিশ্চয়ই বড়ো কোনও অর্ডার এল! জীবনে কি সুখ আছে কোনও?
যাই, দেখি গে!
৭
আমার বাবাটা না কোনও দিন মানুষ হবে না। এই যে এত চুল আঁচড়ে দি, ছাদে বসে কী সুন্দর করে কলপ করে দি, মাঝে মাঝে ভাত খাইয়েও দি, তাতেও আমার বাবা আমাকে বুঝতে পারে না।
নইলে একটু খোঁজখবর নেবে না, যে, মেয়ের একজনের ওপর চাপ আছে, একটু দেখে খেলো এখন?
রবিবার দিন, দিব্যি ঠ্যাঙের উপর ঠ্যাং তুলে লুচি আলুভাজা খাচ্ছি, মা এসে গম্ভীর মুখে বলল, “আজ কোথাও যাবি না।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “কেন?”
মা হাসিমুখে বলল, “সাঁপুই মিষ্টান্ন ভাণ্ডারের কথা বলছিলাম না, ওরা তোকে দেখতে আসবে আজ। আরে সেই যে, ওদের ল্যাংচা বিখ্যাত।”
আমি বলতে যাচ্ছিলাম ল্যাংচা তোমার পেছনে গুঁজে রাখো, অনেক কষ্টে উড়ন্ত চপ্পল থেকে নিজেকে বাঁচিয়ে বললাম, “আমাকে আগে বলোনি কেন?”
মা অবাক হয়ে বলল, “সে কী! পরশু রাতেই তো বাবা বলছিল। তুই খেতে খেতে মোবাইল দেখছিলি আর হুঁ হুঁ করছিলি!”
আমি বললাম, “উফ! আমার কানে হেডফোন ছিল তো! আমি কি অত শুনেছি নাকি?”
মা বলল, “শুনিসনি তো কী হয়েছে? এত ভালো সম্বন্ধ পাবি নাকি কোথাও? সাঁপুইদের মিষ্টি জগৎপুরের বিখ্যাত। কত লোক এসে সাঁপুইদের ল্যাংচা নিয়ে যায়। ওখানকার কোনও নেতা তো কোনও অনুষ্ঠানে সাঁপুইদের ল্যাংচা ছাড়া কিছু মুখেই নেবে না।”
আমি ভালো মানুষের মতো মুখ করে বললাম, “মানে? সাঁপুইদের ল্যাংচায় কী আছে? কত বড়ো? জনি সিন্সের থেকেও বড়ো?”
মা অবাক হয়ে বলল, “জনি কী? সে আবার কী?”
আমি লুচি মুখে দিয়ে বললাম, “ও বুঝবে না তুমি। বুঝে কাজও নেই। আমি আজ থাকতে পারব না।”
মা রেগে গিয়ে বলল, “না থাকার কী আছে? তোর বাবার সম্মান আছে না? আচ্ছা শোন না মা, তোর বাবার প্রেস্টিজের ব্যাপার। আচ্ছা শোন, আজ একটু ভালো করে বস, আমি দুহাজার টাকা দেব তোকে কথা দিলাম।”
আমি খুশি হয়ে বললাম, “দুহাজার? আচ্ছা, দাও তাহলে। এখনই দাও। নইলে কথা রাখতে পারছি না।”
মা গজগজ করে কোমর থেকে একটা গোলাপি পাত্তি বের করে আমার হাতে গুঁজে দিয়ে বলল, “এরপরে যদি না থেকেছিস না কুন্ডি, তাহলে তোর একদিন কি আমার একদিন হবে এই বলে দিলুম।”
আমি এঁটো হাতে মার কোমর জড়িয়ে ধরে বললাম, “কেন থাকব না মা জননী? দুহাজার ফেলেছ, এটুকু তো কত্তেই পারি। তবে শুধু গেস্ট অ্যাপিয়ারেন্স কিন্তু বলে দিলাম!”
মা দুহাত তুলে নমস্কার করে বলল, “তাই করিস মা। জয় জগত্তারিণী, একটু দেখো মা আমার এই পাগলি মেয়েটাকে।”
***
যথাসময়ে তেনারা এলেন। আমার জ্যাঠা কাকারাও এসেছে। বড়ো মামা এসেছে। বাড়ি ভর্তি লোক, যেন মেলা বসেছে। আমি অত বুঝিনি, দুহাজার নিয়ে ভেবেছিলাম অত ঝাম হবে না। এ যে এত ক্যাচালের যজ্ঞ, ভাবতে পারিনি। মাসি এসে গলায় একটা বড়ো হার পরিয়ে দিল। মা শাড়ি পরিয়ে দিল। আমি বললাম, “এ কী করছ? এসব তো কথা ছিল না বন্ধু!”
মা রাগি মুখে বলল, “দুহাজার নিয়েছিস, যা যা বলছি তাই করবি।”
আমি কিছু বললাম না। দাঁড়াও, করছি ব্যবস্থা।
হাতে একটা শিঙাড়ার ট্রে ধরিয়ে দিল মাসি। আমাদের দোকানের বিখ্যাত শিঙাড়া। সেটা নিয়ে বসার ঘরে ঢুকে দেখি আমাদের বাড়ি, তাদের বাড়ি মিলিয়ে একগাদা লোক।
মা শিখিয়ে দিয়েছিল সবাইকে প্রণাম করতে হবে। আমি প্রণাম না করেই বসে পড়লাম। বাবা ইশারা করল, “ওরে কপাল, প্রণাম কর মা।”
আমি শুনলাম না। ছেলের বাড়ি থেকে এক বয়স্কমতো মহিলা এসেছিল। আমায় দেখে বলল, “তোমার নাম কী মা?”
আমি বললাম, “কপালকুণ্ডলা তালুকদার।”
মহিলা বললেন, “একটু হেঁটে দেখাও মা।”
আমি হাসিমুখে বললাম, “হাঁটলাম তো, দেখেননি? শিঙাড়ার ট্রে তো হেঁটেই নিয়ে এলাম।”
বাবা আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘কপাল!’
মহিলা অপ্রতিভ হয়ে বললেন, “তা ঠিক। তুমিই তো এনেছ। আচ্ছা, দাঁত দেখি।”
আমি বললাম, “দেখানো যাবে না, গুড়াকু মেজে এসেছি এখন।”
সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করল। আমার বাবাকে ধরে রাখা যাবে না বুঝছি, হেবি খচে গেছে। মহিলা একটা ছেলের দিকে দেখিয়ে বলল, “তোমাদের কিছু বলার থাকলে নিজেরা কথা বলো।”
ছেলেটাকে দেখলাম। কোথায় চাঁদ আর কোথায় …। কোথায় আমার নবকুমার আর কোথায় এই বাচ্চু কুমার!
ছেলেটা বলল, “একটা গান করো।”
আমি সঙ্গে সঙ্গে শুরু করলাম, “সাইকেলের দুদিক চাকা মধ্যে ফাঁকা, আয় আয় চড়বি কে কলির সাইকেলে।”
ছেলের বাড়ির লোকজন বুঝদারের মতো মাথা নাড়তে লাগল। আমি হাফ গান গেয়ে বুঝলাম এতেও এদের কিছু হচ্ছে না, আমাকে পছন্দ করেই ছাড়বে।
আমি “আমার হাগু পেয়েছে, এলাম, পরে কথা হবে”, বলে ঘর ছেড়ে দৌড় মারলাম।
বাড়ির সবাই হাঁ হাঁ করে উঠল, আমি বাথরুমে ঢুকে বসে রইলাম।
৮ জীমূতবাহন
সব জিনিসের খারাপ ভালো থাকে। কোনও কিছুরই সব খারাপ হতে পারে না।
আমাদের বাড়ির যেমন।
বাড়ি পৌঁছতে রাত সাড়ে নটা বেজে গেল।
রোজ এই সময় আমার বাবা আর মা গম্ভীর মুখে সিঁদুরের দিব্যি বলে কী একটা ঢপের সিরিয়াল দ্যাখে। বাড়ি যখন ঢুকি তখন কেউ দেখতেও পায় না। জুতো খুলে গা হাত পা ধুয়ে নিজের ঘরে গেলেও কেউ টের পায় না আমি এসেছি।