আমি বললাম, “হ্যাঁ নেব। কী দেব বলুন।”
ছেলেটা বলল, “দুটো লেডিকিনি।”
আমি ছেলেটার সামনে থেকে গিয়ে একটা প্লেটে দুটো লেডিকিনি নিয়ে ছেলেটার সামনে রাখলাম, কিন্তু সরলাম না। ছেলেটা আমার দিকে বড়ো বড়ো চোখে তাকাল। বোঝা যাচ্ছিল ভালো মতন ঘাবড়েছে। আমি বললাম, “কী হল? খাবেন না?” ঠিক এই সময়, যখন ইম্প্রেশন জমানোর কঠিন টাইম, মঞ্চে আমার বাবার প্রবেশ ঘটল। চিরকাল তো ফলস সময়েই এন্ট্রি নিতে হয়। স্কুটি থেকে নেমেই জোরে জোরে চ্যাঁচ্যাতে শুরু করল, “কপাল, ওরে ও কপাল, শুনেছিস?”
আমি বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে কড়া গলায় বললাম, “কী হয়েছে, কী এমন মহাভারত অশুদ্ধ হয়েছে?”
বাবা গলা নামিয়ে বলল, “আরে, পাল বাড়ির মেয়ের বিয়ে অন্য বাড়িতে হয়ে গেছে। হেবি ব্যাপার। যা না মা, আমি গেলে খারাপ দেখায়। তুই গিয়ে খবর নিয়ে আয়।” আমি একবার ছেলেটার দিকে, আর একবার বাবার দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে দুম দুম করে পাল বাড়ির দিকে রওনা হলাম।
৬
নবকুমারের নাম জানা গেছে। আমার মতো উদ্ভট নাম না। সুস্থ স্বাভাবিক নাম।
অনির্বাণ রায়। দেখেছেন? কত সিম্পল নাম। এই নামে কত কত বাঙালি আছে। এই যুগে কোন বাপ তার মেয়ের নাম কপালকুণ্ডলা রাখে? আর ঠাকুরদাকেও বলিহারি যাই। দোকানের নাম বিষবৃক্ষ রাখতে আটকালেন আর আমার নামটা চেঞ্জ করতে পারলেন না? শুনেছি, বাবা নাকি ঠাকুরদাকে বুঝিয়েছিলেন কপালকুণ্ডলা নাম দিলেই নাকি সংসারে সুখের সুনামি আসবে।
কী সুনামি এসেছে জানি না, তবে স্কুল কলেজে আমার নাম নিয়ে খ্যাপানোর যা সুনামি হয়, তা আর কী বলব! আমি আজকাল হাল ছেড়ে দিয়েছি। কেউ খ্যাপালে কোনও প্রতিক্রিয়া দিই না। তাতে দেখা যায়, যে খ্যাপাতে এল, সে-ই খেপে যায়। মনে মনে ভাবে এ কী রে ভাই? খ্যাপে না কেন?
তবে আমি অনির্বাণ বলে ডাকি না। নবকুমার বলেই ডাকি। কপালকুণ্ডলার চাপের মানুষ তো নবকুমারই হবে, নাকি? সুচিত্রা ভট্টাচার্যের উপন্যাস আছে কাছের মানুষ। আমি যদি কোনও দিন উপন্যাস লিখি, তাহলে সে উপন্যাসের নাম দেব চাপের মানুষ। চাপের মানুষ বড়োই ভোলাভালা টাইপ।
কখনও সে দাড়ি রাখে, কখনও রাখে না। আবার কখনও কখনও এমনভাবে দাড়ি কাটে যে গলার কাছে একটু দাড়ি থেকে যায়। আমি ভাবি বলব, কিন্তু বলি না। ঠাকুমা বলেছে মেয়েদের একটু ঘ্যামে থাকতে হয়। সমস্যা হল, আমার নবকুমারকে ঘ্যাম দেখিয়ে থাকলে সারাজীবন আমাকে কুমারীই থাকতে হবে। নবকুমারের মতো আলাভোলা ঝাড়িহীন পুরুষ আমি কম দেখেছি।
আমার দিকে তাকাতে যে কী হয় তার কে জানে! এমনভাবে দোকানে আসবে যেন সাড়ে চুয়াত্তরের উত্তমকুমার। কিছুই বোঝে না। পুরো অবাক পৃথিবী মোড।
আসবে, এসে বসবে। খেয়েদেয়েই চলে যাবে। ওরে, তোর জন্য যে একটা মেয়ে আজকে একটু কষ্ট করে ভালো করে স্নান করেছে, কাজল দিয়েছে, আমেরিকা থেকে মেসোর আনা লিপস্টিক দিয়েছে, দেখ রে বাবা নবকুমার!
গোদের ওপর বিষফোঁড়া তো তখন হয়, যখন নবকুমার যেতে না যেতেই পাশের পাড়ার দুষ্টু বুড়োটা দোকানে এসে আমার দিকে জুলজুল করে তাকায়। দুষ্টু বুড়োটা হেব্বি বদ। মেয়ে বা বউ দেখলেই পিঠে হাত দেবে। আমার দিকে তাকালে আমি আগুনে চোখে তাকাই। বুড়ো বসে শিঙাড়া নেয়। একবাটি দুধ নেয়। তারপর দুধে শিঙাড়া চুবিয়ে চুবিয়ে খায়। পাড়ার বদ ছেলেরা দাদুকে দুধে শিঙাড়াও বলে। দাদুর তাতে যায় আসে না। দাদু জিনিস।
দাদুর দুই ছেলেই ভালো চাকরি করে। বিরাট ব্যাপার। দুই ছেলেই বড়ো গাড়ি নিয়ে ঘোরে। কিন্তু দাদুকে দেখলে কে বুঝবে? দাদু আসবে, জুলজুল চোখে তাকাবে। আমার বন্ধু পিউ বলেছে, কিছু কিছু বুড়ো আছে, তাদের শেষ দিন অবধি ইয়ে শুলায়।
আমার দাদুর চোখ ঠিক লাগে না। কেমন বুকের দিকে তাকায়। আমি একদম সহ্য করতে পারি না এরকম ধরনের লোক। আর কিছু লোক আছে বাসে ট্রেনে উঠলেই ঠিক পাছা ঘষবে। যেন ঘষার জিনিসের অভাব আছে পৃথিবীতে। আমি যেই বলি, “দাদা, খুব ঘষতে ইচ্ছা করলে বলবেন, গরম তাওয়া ধরব, সেঁকে নেবেন।” বাস সুদ্ধ লোক হাসে। লোকগুলো দূরে যায় বটে, কিন্তু এদের লাইন শেষ হবার নয়। দাদার বয়সি, বাবার বয়সি, এমনকি দাদুর বয়সি লোকেরাও কিছুদিনের মধ্যেই সবাইকে অবিশ্বাস করতে শিখিয়ে দেবে। সবাইকে সন্দেহের চোখে দেখতে শিখিয়ে দেবে।
আর এইজন্যই এদের মধ্যে আমার নবকুমারকে ভালো লাগে। কোনও ভান নেই, ঝাড়ি নেই। ক্যাবলাকান্ত আসবে। বসে বসে মাথা নিচু করে খাবে। তারপর কোনও দিকে না তাকিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দেবে। আমার খুব ইচ্ছা করে নবকুমারের বাড়ির ভিতর উঁকি দিয়ে দেখি। নবকুমার কী করে? রান্না করে খায় সেটা টের পেয়েছি, আমার ওর রান্নার স্বাদ পেতেও ইচ্ছা করে।
ঠিক করেছি খুব বৃষ্টি হলে, নবকুমারের বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াব। পোড়ামুখী বৃষ্টিও তেমন, এ বছর নামার নামই করে না। কোনও কোর্টে এর নামে মামলা করা গেলে সবার আগে গিয়ে মামলা করে আসতাম।
যাক গে, যা বলছিলাম, নবকুমারকে আমার পছন্দ। আমি খাতায় রোজ নবকুমারের সঙ্গে কথা বলার ১০১ উপায় লিখি আর কাটি।
যেদিন কথা বলবে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে, সেদিন যে কী হবে ভাবতে এখনই আমার বুক দুরুদুরু করে ওঠে।