আমি মাথা চুলকে বললাম, “আমার যতদূর মনে হচ্ছে তিতি থাকলে আমিও বাঁচব না। একদিনেই আমার লাইফটা কেমন মিনি পাকিস্তান করে দিয়েছে। ঘুম থেকে মনে হচ্ছে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বললেই এমন করছে যেন ওনাকে কাছে পিঠে কেউ জয়শ্রীর আম বলেছে। আপনি নিয়ে যান না। আমি বাধা দেব না। বরং একদিন ভালো মদ খাওয়াব। চাইলে শুকনো ডাঙায় ওড়াতেও পারি।”
দাঁত বের করে বললাম আমি।
অমলকান্তি জোরে জোরে মাথা নাড়তে নাড়তে বলল, “আপনি তিতিকে চেনেন না। এখনই যদি আমি যাই, তাহলে অজন্তা ফুটওয়ারের সব হাওয়াই চটি আমার পিঠে ভাঙবে। উঁহুঁ, ওইভাবে হবে না।”
আমি বললাম, “তাহলে কীভাবে হবে?”
অমলকান্তি বলল, “আপনি খুব বাজে ব্যবহার করুন। মারধরও করতে পারেন। তাহলে জেলে যাবেন। আপনাকে বাজে ভাববে। ও কাঁদতে কাঁদতে আমার কাছে চলে আসবে।”
আমি চোখ ছানাবড়া করে অমলকান্তির দিকে তাকিয়ে বললাম, “আমার কপালে ভোট ফর লেফট লেখা আছে যে সারাবছর ফেসবুকে লেফট ফ্রন্টের ক্যাম্পেন করে বিজেপিকে ভোট দিয়ে আসব?”
অমলকান্তি আড়চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, “তা ঠিক। আপনি বুদ্ধিমান লোক। অত সহজে আপনাকে টুপি পরানো যাবে না।”
আমি ভ্যাবলার মতো খানিকক্ষণ বসে থাকলাম। দেখি আবার ফোন আসছে। অমলকান্তি হুমড়ি খেয়ে পড়ে বলল, “তিতি না?” আমি দেখলাম হ্যাঁ। ফোনটা অমলকান্তির দিকে দিয়ে বললাম, “নিন কথা বলুন।” অমলকান্তি আমার দিকে তাকাল। তারপর তড়াক করে উঠে ঘরের ভিতরে দৌড়োতে দৌড়োতে বলল, “ওরে বাবা পাগল নাকি!”
আমি হাঁ করে অমলকান্তির দৌড়ে যাওয়াটা দেখে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে বউ বলল, “এখন কটা বাজে?”
আমি ঘড়ি দেখে বললাম, “আটটা।”
“এখন অফিস করেন? এতক্ষণ কোন ড্রেনে পড়ে আছেন? যেটা আনতে বলেছিলাম কিনেছেন?”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “হ্যাঁ। কিনেছি তো।”
“আধঘণ্টার মধ্যে আসুন। একটা কাজ দিয়েছি, ধেড়িয়ে লাট করে দিচ্ছেন।”
ফোনটা কেটে গেল। আমি কয়েক সেকেন্ড ফোনের দিকে তাকিয়ে রইলাম।
এটা বিয়ের পরের দিন বউয়ের কথা! লাইফটা সত্যিই মুত হয়ে গেল তো!
৫ কপালকুণ্ডলা
হ্যাঁ। এই ভ্যাকচ্যাক নামটা আমার। বাবা বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন, লোকে যেরকম দিদির ভক্ত হয়, মোদির ভক্ত হয়, আমার বাবা তেমনি বঙ্কিমচন্দ্রের ভক্ত ছিলেন। একমাত্র মেয়ের নাম দিলেন তাঁর প্রিয় চরিত্র কপালকুণ্ডলার নামে। কপালগুণে ডাকনাম হল কপাল। কিছু হলেই “কপাল কপাল” করে ডেকে পাড়া বাড়ি মাথায় করাটা বাবার প্রিয় কাজ। এলাকার সবথেকে বড়ো মিষ্টির দোকান আমার বাবার। যদিও কলকাতা থেকে মাড়োয়ারি মিষ্টি এসে দাঁত বসাতে চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের দোকানের ছানার জিলিপি আর শিঙাড়া ওইসব ঢপের মেশিনে বানাতে চাপ আছে কাকা! দোকানের নাম বাবা “বিষবৃক্ষ” রাখবে ভেবেছিল, কিন্তু ঠাকুরদার তাড়া খেয়ে অবশেষে সেটা “তালুকদার মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”-এই সেটল হয়েছে। কাউকে “পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ” বলব বলে আজন্মকাল বসে আছি, কিন্তু গুগল ম্যাপের কল্যাণে এরকম পথিক কাউকে পাব না পাব না করে একজনকে পেয়েছি। পাওয়া মানে একেবারে পাওয়া না। এ পাওয়া সে পাওয়াও না। এই তো সেদিনের কথা।
গরমের দিনের দুপুরবেলা। কলেজ থেকে ফিরতে দেখি বাবা ব্যস্তসমস্ত হয়ে আমাকে বলল, “কপাল, ক্যাশ সামলা, কাল রাতের খাসির সাথে আম দুধ খেয়ে আমার গ্যাস হয়ে গেছে বোধহয়। যাচ্ছি আর আসছি। আমি আর পারছি না মা, তুই দেখ, আমি যাই।” বলেই স্কুটি নিয়ে বাবা ধাঁ। আমি আর কী করব, ক্যাশে বসে দুখান রসগোল্লা আর দুটো কালোজাম নিয়ে মনোযোগ দিয়ে খাচ্ছি, এমন সময় এক ক্যাবলাচরণ নবকুমার এসে ঘাম মুছতে মুছতে বলল, “আচ্ছা, হাবলু মিত্রর বাড়িটা কোথায় বলতে পারবেন?” হাবলু মিত্রর বাড়ি কাক চিল তিষ্ঠোতে পারে না আর ভাড়াটে!
এক মাস পর পর নতুন ভাড়াটে আসে। বুঝলাম এ নয়া চিড়িয়া। আমি বলতে যাচ্ছিলাম, “পথিক তুমি কি পথ হারাইয়াছ”, কিন্তু বললাম না।
উলটে বললাম, “আপনি কোত্থেকে আসছেন?” ছেলেটা বলল, “মুর্শিদাবাদে বাড়ি। এখানে ভাড়া পেলাম। বাড়িটা বলবেন? লাগেজ রেখে বেরোতে হবে আবার খেতে।”
আমি দোকানের একটা পুচকেকে ঠিক করে দিলাম। পুচকেটা ঘুরে এসে রিপোর্ট দিল হাবলু মিত্র নতুন চিড়িয়াকে সাদরে আমন্ত্রণ করেছে। মিটিমিটি হাসলাম। কদিন টেকে, দেখার সেটাই। ছেলে সিরিয়াস। ঝাড়ি-টারি দূরের কথা, মুখের দিকে তাকিয়ে পর্যন্ত দ্যাখে না। হনহন করে বেরিয়ে যাবে, আর সন্ধের সময় এসে দোকান থেকে দুখানা শিঙাড়া নিয়ে চলে যাবে। আমি যে কতবার গলা খাঁকড়ানি দি, দেখবেই না। বাগে পেলে কানের টেস্ট করতাম। শিওর কালা আছে। আর সব থেকে অবাক কথা হল আমাদের চমকে দিয়ে এ ছেলে টিকেও গেল। হাবলু মিত্রর বাড়ি টিকে যাওয়া যে সে কম্মো না। তবে কানে শুনতে পায় না বলেই হয়তো টিকে গেল। নইলে হাবলু মিত্রের বউয়ের যা শুচিবাই, বাবা রে! সেদিন সন্ধেবেলা। দোকানে গিয়ে ঘুরঘুর করছি, কারণ তখন বাবুর আসার টাইম হয়ে গেছে। বাবাও নেই। কোথায় জানি গেছে। দেখি ছেলেটা ঠিক এসেছে। একটা টেবিলে বসে ইতিউতি তাকাচ্ছে। ভুঁড়িবাবু যাব যাব করছিল, আমি ওকে সরিয়ে ছেলেটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বললাম, “কী দেব?” ছেলেটা আমাকে দেখে ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “মানে আপনি অর্ডার নেবেন?”