আমি উঠতেই বলল, “তারপর, বোসো, সব ঠিক আছে তো? ফুলশয্যার পরের দিনই অফিস করছ, ছুটি নিতে পারতে তো!” আমি হে হে করে একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসলাম। ঈশান ফেবিকুইক। আমার পাশে এসেই বসল। বিড়বিড় করে বললাম, “সব শালাকে বুলডোজারের তলায় ফেলব। তোকেও।”
ঈশান আমার পেটে চিমটি দিয়ে বলল, “এরকম করিস কেন? সব ঠিক হয়ে যাবে। একটু হাস না ভাই।” আমি দাঁত বের করতে যাব, আমার ফোন বেজে উঠল। দেখি আননোন নাম্বার।
ধরলাম, “হ্যালো।”
“আমার প্যাড আনা হয়নি। ডেট সামনেই।”
অবাক হয়ে বললাম, “কে? কে আপনি? কী প্যাড? রাইটিং প্যাড?”
“আমি আপনার বিয়ে করা বউ। প্যাড মানে এখনও না বুঝলে বিয়ে করলেন কেন?”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে বললাম, “আমি কোথায় বিয়ে করতে চেয়েছিলাম?”
“চাননি, করেছেন তো! সব ভেঙেচুরে পালান তো নি! সাইজ মেসেজ করছি, নিয়ে আসবেন। আরও অনেক কিছু লাগবে। আমার অ্যাকাউন্ট নাম্বার দিচ্ছি। টাকা পাঠান। কিনতে যাব। চিন্তা করবেন না, হিসাব রাখছি, চাকরির অ্যাপ্লাই করা আছে, পেয়ে গেলে সব টাকা দিয়ে দেব। আপনার টাকা আমার লাগবে না।” ফোন কেটে গেল। আমি হাঁ করে ফোনটার দিকে তাকিয়ে ফোনটা পকেটে রাখলাম।
৩
কাজের চাপে পাথর চাপা অবস্থা। মাঝে মাঝে কফি খেয়ে জল থেকে মাথা তুলতে পারছি কোনও রকমে, আবার কিউবিকলে পৌঁছে জলে ডুবে যাচ্ছি। ব্ল্যাক হোল না কার হোলের ছবি তুলছে বিজ্ঞানীরা আর আমরা এদিকে কোডিং করে যাচ্ছি। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। আমাদের দেওয়ালেই বস আবার একটা হাসিমুখো বুড়োর পোস্টার চিপকে দিয়েছে। তাতে আবার লেখা “গেট এ লাইফ ম্যান।” কী যে লাইফ পাচ্ছি আমিই জানি। লাঞ্চের একটু আগে পঞ্চা বেয়ারা এসে আমার দিকে ঝুঁকে কানে কানে এসে বলল, “আপনার সঙ্গে কে দেখা করতে এসেছে।” পঞ্চা এভাবেই কথা বলে। কথা বলার সময় পঞ্চার পান খাওয়া মুখ থেকে পানের পিক আপনার কানে লাগতেও পারে কপাল ভালো থাকলে।
আমি ছিটকে চিড়বিড়িয়ে উঠে বললাম, “এভাবে বলার কী আছে?”
পঞ্চা কোনও উত্তর না দিয়ে এমনভাবে দাঁড়িয়ে রইল যেন কোনও সিক্রেট মিশনে রয়েছে। আমি রেগেমেগে বেরোলাম। অফিসের লবিতে গিয়ে দেখি একজন লম্বা একহারা চেহারার লোক, আমারই বয়সি হবে, উদাস মুখে অফিসের ফ্যান দেখছে। আমি গিয়ে বললাম, “আমায় ডাকছেন?” লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাত জোড় করে বলল, “নমস্কার, আমি অমলকান্তি।” আমি হাঁ করে বললাম, “ও! তো আপনি কি রোদ্দুর হতে চান?”
অমলকান্তি বলল, “সে তো বিক্রম হয়েই রয়েছে ফাগুন বউতে। আমি আর রোদ্দুর হতে চাই না। আমি আমার প্রেমিকাকে চাই, যাকে আপনি বিয়ে করেছেন।” আমি অমলকান্তির দিকে তাকালাম। কথায় বিনয় ঝরে পড়ছে। ইনিই তাহলে তিনি? মাথা চুলকে বললাম, “খামোখা পালাতে গেলেন কেন? দিব্যি তো বিয়েবাড়িটা খেতে গেছিলাম। মাংস আসার আগেই তুলে নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসিয়ে দিল। আপনার জ্বালায় মাংসটাও তো খেতে পারলাম না।”
অমলকান্তি সোফায় ধপ করে বসে পড়ে বলল, “ভয়ে। তিতি অতি দজ্জাল একজন মেয়ে। প্রতিটা ঝগড়া হ্যাশট্যাগ ফেমিনিজম দিয়ে ফেসবুকে দেয়। আমি ভয়ে পালিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম বিয়ের পর এ মেয়ে নির্ঘাত আমায় জেলে ঢোকাবে। রেডি হচ্ছিলাম, বুঝলেন তো। হঠাৎ করে কে এক আত্মীয় এসে ফোর নাইন্টি এইট এ নিয়ে দীর্ঘ একখান লেকচার দিয়ে বলল, বউকে পায়ের তলায় না, মাথার উপরে রাখতে হবে। বউ মাথায় হাগবে মুতবে সব করবে। দরকার হলে বউকে তুমি হাগিস পরিয়ে দেবে। কিন্তু বউয়ের পাছায় চিমটি কাটলেই বউ বাঙালকে হাইকোর্ট দেখিয়ে দেবে। সেটা শোনার পর থেকে আমার টেবিল টেনিস বল জোড়া আউট হয়ে গেল বুঝলেন? আমি জাস্ট পালিয়ে গেলাম। প্রথমে দেওঘর। সেখানে নিরিমিষ সহ্য করতে না পেরে পাটনা চলে গেলাম। কী জ্বালা বলব মশাই, সেখানে আবার নীতিশ কুমার মদ ব্যান করে দিয়েছে। অগত্যা গুটখা খেতে হল। গুটখা আগে কোনও দিন খাইনি। হোটেলের দেওয়াল নোংরা-ফোংরা করে খুব কষ্ট হল। মনে পড়ল এই মেয়েটাকে নিয়েই তো কতবার পার্কে বসে মশার কামড় খেয়েছি। গালে চুমু খেতে গিয়ে গালে চড় খেয়েছি। তিতিকে আমি ছেড়ে দিলাম কী করে? সটান পাটনা থেকে চলে এলাম জেনারেল কামরায় করে। একটা বিহারি বাচ্চা কোলে বসিয়ে দিয়েছিল, সেটা আবার হিসি করে দিয়েছে গায়ে। দেখুন দেখুন।” অমলকান্তি জামাটা আমার দিকে এগিয়ে দিল। আমি ছিটকে গেলাম, “এই না না। এসব দরকার নেই। আপনি কী করতে চান সেটা বলুন।” অমলকান্তি করুণ মুখে বলল, “এই বিয়েটা আপনি অস্বীকার করুন। ডিভোর্স দিন। আমার প্রেমিকাকে আমাকে বউ হিসেবে পেতে দিন।” আমি বললাম, “সে তো করাই যায়, কিন্তু আমি যে বউভাতে এতগুলো টাকা খরচ করলাম?” অমলকান্তি আমার দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে একটা এটিএম কার্ড আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল, “পিন কোড ওয়ান থ্রি ফাইভ নাইন। ইউজ করুন। যেদিন ইচ্ছা হবে আমাকে দেবেন। এবার হবে?” আমি দাঁড়িয়ে মাথা চুলকে কিছুক্ষণ পরে বললাম, “আপাতত আমাকে একটা প্যাকেট হুইস্পার এনে দিতে পারবেন?”
৪
শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও সত্যি আমি এখন অমলকান্তির ফ্ল্যাটে এসেছি। অমলকান্তি কবি। আমার বউ কবি অমলকান্তির প্রেমে পড়েছিল। কিন্তু অমলকান্তি রোদ্দুর হবার আগেই ভোর থাকতে পালিয়ে যাওয়ায় বিয়েটা আমাকে করতে হয়েছে। মেঝেতে বসে ওল্ড মংকের বোতল থেকে পবিত্র সন্ন্যাসী ঢালতে ঢালতে আর চোখের জল ফেলতে ফেলতে অমলকান্তি বলল, “তিতিকে ছাড়া আমি বাঁচব না বিশ্বাস করুন। ওকে ফিরিয়ে দিন আমায়।”