দীপ বিড়বিড় করে বলল, “তাও ভালো আপনার কোনও চিত্রলেখা ছিল না।”
ধ্রুব অবাক চোখে দীপের দিকে তাকালেন, “মানে?”
মানালি বলল, “উনি বলতে চাইছেন সেই সময়ে কোনও তৃতীয় কেউ ছিল না আপনাদের দুজনের মধ্যে।”
ধ্রুবর সিগারেট শেষ হয়ে গেছিল। আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “আমার ছিল। আমার দু-তিন জন ছিল। আঁতলামি প্রেম যাকে বলে। বরাবরই আমি দুশ্চরিত্র। ঈপ্সিতা থাকলে আরও বেশি। ওর অনুপস্থিতিতেই বরং আমি সচ্চরিত্র হয়ে যাই।”
দীপ অবাক গলায় ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনার হিংসা হত না?”
ধ্রুব বললেন, “হত না আবার? কিন্তু মেয়েরা কখনও সরাসরি মুখে বলবে না হিংসার কথা। আকারে ইঙ্গিতে কথায় পরোক্ষে বোঝাবে। ঈপ্সিতাও তাই। আমি ইচ্ছা করে ওকে রাগানোর জন্য আরও বেশি করে ওদের সঙ্গে ফ্লার্ট করতাম। যাই হোক, সেগুলো তো সব রিলেশনেই হয়, নাথিং স্পেশাল, স্পেশাল যেটা হল, আমার তখন ফার্স্ট সিনেমার শ্যুট শুরু হচ্ছে। ঠিক তখন ঈপ্সিতা কলেজ সার্ভিস কমিশন পাশ করল এবং ওর প্লেসমেন্ট হল উত্তরবঙ্গে। ঈপ্সিতা আমার সঙ্গে কোনও রকম কনসাল্ট না করে চাকরিটা ছেড়ে দিল। ওর কলেজেই বিশ্বরূপ পড়তেন, বিশ্বরূপ সহ ওর অনেক বন্ধুরই ধারণা হল আমিই ওকে চাকরিটা করতে দিইনি। অথচ বিষয়টা একেবারেই তা নয়।”
বিশ্বরূপদার নাম শুনে মানালি খানিকটা চমকাল।
ধ্রুব বলে চললেন, “অভাবের সংসার, খুব বেশি টাকা আসছে না। এদিকে সহধর্মিণী চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন জানতেও পারিনি। তখন এই ফ্ল্যাটটা ছিল না। থাকতাম ছোটো একটা বাড়ি ভাড়া নিয়ে। এর মধ্যেই একদিন তুমুল ঝামেলা। সাবান বা শ্যাম্পু কিছু একটা নিয়ে মে বি। আমি ভয়াবহ কিছু কথা বলে ফেলেছিলাম ওকে, বরাবরই আমি দুর্মুখ, কারও সঙ্গে ঝগড়ায় সেসব আরও বেশি করে বোঝা যায়, ঈপ্সিতা কোনও দিকে তাকাল না, বাড়ি চলে গেল।”
“এবং এই গল্পে কোথাও শ্রীপর্ণা ঘোষাল নেই।” ঈপ্সিতা কথাটা বলে চুপ করে গেলেন।
মানালির অপরাধবোধ জন্মাচ্ছিল। সে বলল, “বুঝতে পারছি। উনি অনেক পরে এসেছেন।”
ধ্রুব বললেন, “কোনও কালেই আসেননি। বন্ধুরা বন্ধুই থাকেন।”
দীপ আগ্রহভরে জিজ্ঞেস করল “আপনি কখনও ওঁর রাগ ভাঙাতে যাননি?”
ধ্রুব সিগারেট ধরালেন, “আশ্চর্যজনক হলেও কথাটা সত্যি, ঝগড়াটা হয়েছিল তুচ্ছ কারণে, ঈপ্সিতা রূপনারায়ণপুরে চলে গেছিল, এদিকে ‘রেনেসাঁ’-র শুটিং তখন তুঙ্গে, কিছুতেই ও ফোন ধরছে না, একদিন শুটিং ছিল না, ঠিক করেছিলাম পরের দিন যাব, রাস্তায় টালিগঞ্জ মেট্রোর কাছে ওর এক বন্ধু আমাকে যা নয় তাই বলে গেল। আমার জন্য মেয়েটা নাকি কেরিয়র শেষ করেছে, কলেজে চাকরি পেয়েও গেল না ইত্যাদি ইত্যাদি। আমার ধারণা হল ও-ই বন্ধুদের কাছে কাঁদুনি গেয়েছে, তুমুলভাবে রেগে গেলাম, সব কিছু শেষ করে দিলাম। আর গেলামই না। প্রবল জেদ ধরে ছিলাম। এর মধ্যেই সরকারি কোটায় এই ফ্ল্যাটটা কিনতে পারলাম।”
দীপ বলল, “আপনি গেলেন না, কোনও দিন যোগাযোগও হয়নি দুজনের? তবে? আজ হঠাৎ উনি এখানে?”
ধ্রুব মানালির দিকে আঙুল তুলে দেখালেন, “সৌজন্যে এই ভদ্রমহিলা।”
দীপ একবার ধ্রুব, একবার ঈপ্সিতা, আর-একবার মানালির দিকে তাকিয়ে বলল, “শুধু স্যান্ডউইচেই কর্তব্য সেরে ফেললেন? উনি তো মিরাকল করেছেন!”
ঈপ্সিতা দীপের দিকে তাকালেন, “তা ঠিক। তবে কী জানেন তো, এতদিন পরে এসে আমরা দুজনেই বুঝতে পারি, সম্পর্কে দূরত্বেরও একটা দরকার আছে। আমরা দুজনে যথেষ্ট লাকি যে সাবান শ্যাম্পুর মতো ছোটোখাটো ব্যাপারেই সব কিছু শেষ হয়ে গেছিল। সে কারণেই হয়তো এত দিন পরেও আমরা পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কথা বলতে পারি।”
মানালি বলল, “আপনাদের ডিভোর্স হয়নি কোনও দিন, তাই না?”
ধ্রুব হাসলেন, “বিয়েই হয়নি কোনও দিন। আমরা লিভ টুগেদার করতাম। সবাই জানত বিয়ে। আপনাদের স্টোরি কোনও দিক থেকেই দাঁড়ায় না।”
মানালি হাঁ করে ধ্রুবর দিকে তাকাল।
ধ্রুব বললেন, “কেসটা রাগের মাথায় করব ঠিক করেছিলাম। সেসব আর করব না।”
মানালির মনে হল মাথা থেকে একটা বড়ো পাথর নেমে গেল। অকারণেই তার চোখের কোণ ভিজে উঠল।
দীপ বলল, “আপনারা তার মানে আজ থেকে একসঙ্গে থাকছেন?”
ধ্রুব ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে হাসলেন, “দেখা যাক, পাগল তো দুজনেই। এখন থেকে দু ঘণ্টা পরে কোথায় যাব তাও জানি না। তবে অনেক দিন পরে ওর হাতে আলু পোস্ত খাব। আমার মতো মাতাল লোক, যার খাওয়ার ঠিক নেই, তার জন্য এটা তো একটা সুখবরই বটে।”
মানালির ফোন বাজছিল। দেখল বিশ্বরূপদা।
মানালি ধরল, “বলো।”
“শোন, চিন্তা করিস না, পরিস্থিতি এখন অনেকটাই কন্ট্রোলে। বিতস্তা ভীষণ কাঁদছে, তবে সামলে নেব। তোর আজকে অফিসে না এলেও হবে। কিন্তু কাল থেকে বিতস্তা যেন অফিসে আসে, স্বাভাবিক থাকে, এই দায়িত্বটা তোকে নিতে হবে। পারবি তো?”
মানালি বলল, “পারব।”
“কোথায় আছিস এখন?”
মানালি ধ্রুব আর ঈপ্সিতার দিকে তাকিয়ে বলল, “বন্ধুর বাড়ি।”
“ওকে। চোখ কান খোলা রাখ। নতুন যা নিউজ পাবি, নোট করতে থাক। একজন ভালো সাংবাদিকের কখনও বিশ্রাম নেই, মনে রাখিস।”
ফোনটা রেখে দিল বিশ্বরূপদা।
মানালি ধ্রুবর দিকে তাকাল, “বিশ্বরূপদাকে বলবেন না কোনও দিন?”