গুরুদেব কটমট করে দীপের দিকে তাকালেন।
৩২
মানালির বাড়ি ঢুকতে ঢুকতে রাত নটা বাজল। বাবা টিভি দেখছিল। তাকে দেখে বলল, “চাইনিজ খাওয়াটা আর হল না আজ। যাক গে, আসন্ন ভ্যালেন্টাইন্স ডে-তে ব্যবসায়ী সমিতির উন্নতিকল্পে কত টাকা দান করছিস?”
মানালি হাসল। বাবার কথাবার্তা এমনই। তার ক্লান্ত লাগছিল। ব্যাগটা সামনের টেবিলের রেখে সোফায় বসে বলল, “মা কোথায়?”
বাবা বলল, “ঘুমোচ্ছে। সান্ধ্যকালীন নিদ্রা।”
মানালি বলল, “যাক বাঁচা গেল, তবে দশটার মধ্যেই উঠে পড়ে সাধারণত।”
বাবা বলল, “অদ্ভুত অভ্যাস যাই বলিস, এর পর রাত বারোটা অবধি বাসন মাজবে। সেই কবে থেকে দেখছি।”
মানালি বলল, “তার আগে খেয়ে নিতে পারলে ভালো হয়। নইলে আবার শুরু করবে।”
বাবা বলল, “শুরু যাতে না করে সেই ব্যবস্থা করলেই তো পারিস।”
মানালি বলল, “প্লিজ বাবা। তুমিও শুরু কোরো না।”
বাবা বলল, “শুরু করছি না। জাস্ট আস্কিং। ছেলেটা কে? কী করে?”
মানালি অবাক হয়ে বলল, “ছেলে পেলে কোত্থেকে?”
বাবা বলল, “তুই যে বলেছিস তোর বয়ফ্রেন্ড আছে, ভুলে গেলি?”
মানালির মনে পড়ল। সে বলল, “ও আছে একজন।”
বাবা বলল, “অফিসের?”
মানালি মাথা নাড়ল, “না, অফিসের না।”
বাবা বলল, “তবে?”
মানালি বলল, “এম এন সিতে কাজ করে।”
বাবা খুশি হল, “বাহ, খুব ভালো তো। বিয়ে করে ফেল। তোর মা বাঁচে, তুই আর আমি দুজনেই বাঁচি।”
মানালি মাথায় হাত দিল। বলল, “বাবা, আমি অফিসে একটা ব্যাপার নিয়ে ভীষণভাবে ফেঁসে আছি, প্লাস একটা হাউস থেকে এই কিছুক্ষণ আগে বেশি মাইনের চাকরির অফার এসেছে। সব কিছু নিয়ে আমি খুব কনফিউজড। এর মধ্যে মিক্সার মেশিনে আবার আমার বিয়েটা ঢুকিয়ো না প্লিজ। আমি জাস্ট পাগল হয়ে যাব বিশ্বাস করো।”
বাবা বলল, “কী ব্যাপারে ফেঁসেছিস? আজকের নিউজটা যেটা করেছিস সেটা নিয়ে?”
মানালি বলল, “ওই হল। ওই ব্যাপারগুলো নিয়েই আর কি।”
বাবা বলল, “এগুলো তো সব অকুপেশনাল হ্যাজার্ডস। সবার থাকে। তোরও আছে। থাকবে। তার জন্য কি নাওয়া খাওয়া ভুলে সব সময় চিন্তা করে যাবি? এক কাজ কর, একদিন ছেলেটাকে বাড়িতে ডাক, আমি কথা বলি। চিন্তা করিস না, আমার ছোঁড়াকে পছন্দ না হলেও সেই ছোঁড়ার সঙ্গেই তোর বিয়ে দেব। এসব ব্যাপারে আমি একেবারেই পিউরিটান নই।”
মানালি বাবার দিকে রাগি চোখে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে বলল, “তোমাকে কি মা ব্রেইন ওয়াশ করেছে সারাদিন ধরে?”
বাবা হাসল, “কেন বল তো?”
মানালি বলল, “এই যে একই কথা অন্য ভার্সনে বলে যাচ্ছ! আচ্ছা বাবা, বিয়ে দিয়ে কী এমন লাভ হয় বাবা-মায়ের? তোমরা কেন এখনও এই সময়ে এসেও একটা ছেলে আর একটা মেয়েকে একই ভাবতে পারো না? মেয়ে পার করতে পারলেই স্বস্তি তাই না?”
বাবা বলল, “আচ্ছা, আচ্ছা, তুই রেগে যাস না। তুই যদি রেগে যাস তাহলে আর তো কোনও কথাই বলা যাবে না। তোকে আমি আলাদা কোনও দিনও ভাবিনি, কিন্তু মা, আমাদেরও তো ইচ্ছা করে ছেলেটার সঙ্গে দেখা করতে। এগুলো তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাই না? আজ না হয় কাল তোরা বিয়ে করবি, এতদিন তোকে বড়ো করলাম, আমাদেরও তো খানিকটা অধিকারবোধ জন্মায় তোর ওপরে?”
বাবার গলা খানিকটা অভিমানী শোনাল।
মানালি টিভির দিকে তাকাল। ধ্রুব বাগচীর খবরটা দেখাচ্ছে। রূপনারায়ণপুরে চলে গিয়েছিল সাংবাদিকরা। ঈপ্সিতা কাউকেই ঢুকতে দেননি। ফোনে শ্রীপর্ণা ঘোষাল জানিয়ে দিয়েছেন তাঁর এবং ধ্রুব বাগচী সম্পর্কে যা যা রটছে তা সম্পূর্ণ গুজব। তাঁরা খুব ভালো বন্ধু। বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এভাবে মিসইন্টারপ্রেট করায় যে তিনি অত্যন্ত ব্যথিত তাও দেখাচ্ছে।
বাবা বলল, “কিছু বল।”
মানালি বলল, “দেখবে দেখবে। চিন্তা করছ কেন?”
বাবা বলল, “ফটো আছে?”
মানালি নিঃশ্বাস ছাড়ল, “না বাবা।”
বাবা বলল, “এইসব সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর যুগে ফটো পাওয়া এমন কোনও চিন্তার ব্যাপার না। সেসব নিয়ে আমি ভাবছি না। যাক গে, বয়সের ডিফারেন্স স্বাভাবিক তো! আজকাল যা হচ্ছে! হয় মেয়েটা ছেলেটার থেকে দশ বছর বড়ো, নইলে কোনও বুড়োর সঙ্গে অষ্টাদশবর্ষীয়া কন্যার বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। তোর আবার কুড়ি তিরিশ বছর বড়ো কোনও কাকু জেঠু পছন্দ হয়ে যায়নি তো? হয়তো দেখা গেল তার স্ত্রীও আছে। দেখিস, কারও সংসার ভাঙিস না যেন।”
মানালি হাত জোড় করল, “প্রণাম বাবা। তোমার কল্পনাশক্তি পৃথিবীর সেরা লেখকের থেকেও এক কাঠি ওপরে। তুমি বরং লেখালেখি করো।”
বাবা বলল, “কী করব বল! তোদের জেনারেশনটাকে একেবারেই বুঝতে পারি না। আবার ভালোও লাগে। তোর যে নিজের পায়ে দাঁড়াবার ইচ্ছেটা হয়েছে সেটাকেও অ্যাপ্রিশিয়েট না করে পারি না।”
মানালি বলল, “থ্যাংকস বাবা। এতক্ষণ পরে একটা ভালো কথা বললে।”
বাবা বলল, “কথা আমি সব ভালোই বলি। তুই শুধু বুঝতে পারিস না এটাই প্রবলেম। যাই হোক, মাকে ডাক, খেয়ে নে। বা মা আসার আগেই খেয়ে নে। তাহলে আর একগাদা প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে না তোকে।”
মানালি বলল, “আর খেয়েই বা কী হবে? যা গেল সারাটা দিন, আমার আর কিছু পেটে ঢুকবে না।”
বাবা বলল, “কী গেল? সমস্যাটা কী?”
মানালি বলল, “সে অনেক সমস্যা। সব বলে লাভ নেই। বুঝবেও না।”