দীপ গম্ভীর গলায় বলল, “টিভিটা বন্ধ করো একটু। কথা আছে।”
মা বিরক্ত গলায় বলল, “বল না। বলতে কী অসুবিধা।”
দীপ বলল, “ঠিক আছে, এটা দেখে নাও, তারপরে বলছি।”
মা বলল, “পরে কী করে বলবি? এর পরে সন্ন্যাসী রাজা আছে, কুসুমদোলা আছে, গোপাল ভাঁড় আছে, রাত এগারোটার আগে আমি উঠতেই পারব না টিভির সামনে থেকে আজকে। যা বলার টিভি চলতে চলতেই বল।”
দীপ বলল, “আমার জন্য মেয়ে দ্যাখো। আমি বিয়ে করব।”
দীপের মুখ থেকে কথাটা বেরোতে বাবা মা তার দিকে হাঁ করে তাকাল। মার হাত থেকে রিমোটটা খসে গিয়ে মেঝেতে পড়ে সেটার ব্যাটারি বেরিয়ে গেল। বাবা বলল, “তোর নাকি নিজে নিজেই মেয়ে দেখা ছিল?”
দীপ বলল, “সব ক্যানসেল। তোমরা মেয়ে দ্যাখো। আমি বিয়ে করব।”
মা রিমোটটা তুলে ব্যাটারি লাগিয়ে টিভির ভলিউম বাড়িয়ে দিয়ে বাবাকে বলল, “ওর কথায় কান দিয়ো না। তুমি মেয়ে দেখে আনবে তারপর ও ঠিক ভেগে যাবে।”
বাবা বলল, “বুঝেছি। চতুর্থ পানিপথ।”
মা বলল, “মানে?”
বাবা বলল, “চতুর্থ পানিপথের যুদ্ধ হয়েছে আর কি! ঝগড়া করেছে।”
দীপ বলল, “দ্যাখো মা, আমি সেদিন ইচ্ছা করেই বলেছিলাম, আমার গার্লফ্রেন্ড আছে, তোমাদের কাটানোর জন্য। কোনও কালেই ছিল না। তোমরা মেয়ে দ্যাখো।”
মা বাবার দিকে তাকাল। বাবা মায়ের দিকে।
কয়েক সেকেন্ড পরে মা বলল, “কালকে তোকে গুরুদেবের কাছে নিয়ে যাব। কথা বলিস সামনাসামনি। উনি যা চাইবেন তাই করা যাবে।”
দীপ রেগে গেল, “গুরুদেব কী করবে? তা ছাড়া এসব ভণ্ড পাবলিক আমি কাকে বিয়ে করব সেটা ঠিক করে দেবে নাকি? বাবা, তুমি মাকে বোঝাও! এসব ধর্মগুরু সবকটা জালি হয়। যে জিনিসটার অস্তিত্বই নেই, তার দালালি করে মানুষকে টুপি পরিয়ে যাবে, তারা আবার ঠিক করে দেবে কে কাকে বিয়ে করবে, এসব অ্যাবসার্ড না?”
মা রেগে গেল, “এসব কথা বলবি না আমার সামনে। আমি কিন্তু সব কিছু মানি।”
বাবা বলল, “পিকে আমিও দেখেছি দীপ, ব্যাপারটা সেটা না। ব্যাপারটা হল কী এমন হল যে হঠাৎ করে তুই বিয়ে করার জন্য এরকম খেপে উঠলি?”
দীপ বলল, “ইচ্ছা হল।”
বাবা বলল, “ইচ্ছা হওয়া ভালো। কিন্তু কোনও প্রবলেমে আছিস, সেটা থেকে বাঁচার জন্য যদি বিয়ে করতে চাস তাহলে তুই বড়ো ভুল করবি। মানে তপ্ত কড়াই থেকে ফুটন্ত তাওয়ায় ঝাঁপিয়ে পড়ে খুব একটা লাভ হয় কি?” বাবা গলা খাঁকড়াল, “বিয়ে করে লাইফটা নরক করার কোনও অর্থ নেই।”
মা বলল, “তুমি থামো। আমি কাল সকালে একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট নিচ্ছি গুরুদেবের চেম্বারে। তুই আমার সঙ্গে একবারে রেডি হয়ে বেরোবি। ওখান থেকে অফিসে চলে যাবি।”
দীপ গোঁজ হয়ে রইল।
***
গুরুদেব শ্রী শ্রী একশো আট চাঁদবদন মহারাজ আলাউদ্দিন খলজির মতো একটা পদ্মফুল নাকে গুঁজে বসেছিলেন। সামনের ফরাসে খান তিরিশেক লুচি সাজানো। দীপ আর মা গুরুদেবের চেম্বারে ঢুকতে গুরুদেব ইশারায় দীপের মাকে বেরিয়ে যেতে বললেন।
মা বেরিয়ে গেল। ঘরে আর কেউ নেই। শুধু দীপ আর গুরুদেব।
নাক থেকে পদ্মফুলটা নামিয়ে গুরুদেব একটা লুচি মুখে পুরে বললেন, “তোমার মা বলছেন তুমি নাকি বিয়ে করতে চাও? কেন?”
দীপ বলল, “ইচ্ছা।”
গুরুদেব বললেন, “কেন? এমন ইচ্ছা হবার কারণ?”
দীপ গুরুদেবের দিকে তাকাল। মাথার বেশিরভাগ চুল পেকে গেছে। খুব করে চন্দন সাবান দিয়ে স্নান করেছেন সম্ভবত। ঘরময় চন্দনের গন্ধ। ঘরের ধুপকাঠিতেও চন্দনের গন্ধ।
দীপ একটু অধৈর্য হয়ে বলল, “আপনার কী দাবি? সারাজীবন একা একা কাটিয়ে দেব?”
গুরুদেব কয়েক সেকেন্ড তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, “তোমার কম বয়েস। এই বয়স ঠাকুর দেবতা মানার বয়স নয়। তুমি সেটা মানোও না সেটা তোমাকে দেখলে বোঝা যায়। নিতান্ত সমস্যায় পড়েই তুমি এখানে এসেছ। আমরা বন্ধুর মতো কথা বলতে পারি। তুমি নির্দ্বিধায় আমাকে তোমার সমস্যা বলতে পারো। ভয় নেই। আমি তোমার কোনও কথাই পাঁচকান করব না।”
দীপ গুরুদেবের কথায় একটু অবাক হল। এতটা যুক্তি দিয়ে কথা বলবেন উনি, সেটা সে ভাবতে পারেনি। চারদিকে তাকিয়ে বলল, “আমি সেক্স করেছি দু-তিন দিন হল। তারপর থেকে আমি অন্য কিছুতে মন বসাতে পারছি না।”
গুরুদেব বললেন, “তার মানে তোমার কথা অনুযায়ী শারীরিক চাহিদার জন্যই তুমি বিয়ে করতে চাইছ, তাই তো?”
দীপ বলল, “অনেকটা তাই।”
গুরুদেব গম্ভীর হলেন। বললেন, “বলতে পারবে কেন ‘যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে’ গানটা এত জনপ্রিয়?”
দীপ বলল, “এর মধ্যে এই গানটা এল কোথা থেকে?”
গুরুদেব দীপের কথার উত্তর না দিয়ে বললেন, “এই কারণেই জনপ্রিয় যে মানুষ সবথেকে বেশি নিজেকেই ভালোবাসে। গানটা শুনতে শুনতে যখন মানুষ ভাবতে শুরু করে সত্যিই তো, যেদিন আমি থাকব না, তখনও তো সব থাকবে। শুধু আমি থাকব না। যাই হোক, বেশি বলে ফেলছি তবু বলি, তুমি যে কথাটা বললে সেটা আসলে নিজেকে ভালোবাসা। তুমি এই মুহূর্তে কাউকে ভালোবাসার অবস্থায় নেই। তোমার ভালোবাসায় ভালোবাসা কম, শরীর বেশি। এভাবে সম্পর্ক টেকে না যদিও।”
দীপ বলল, “সেইজন্যই তো ঠিক করেছি বিয়ে করব। এক কাজ করুন, আপনিও আমার জন্য একটা মেয়ে দেখুন। ঘটকালিও হবে, গুরুদেবগিরিও হবে। কী বলেন?”