মানালি ম্লান হল খানিকটা, “আমার বোধহয় আর বেশিদিন চাকরি করা হয়ে উঠবে না।”
ঋপণ ক্যামেরার ব্যাগ ঠিক করতে করতে বলল, “ধুস, ছাড় তো! অফিসে এসব চলতেই থাকে। তবে তোকে অনেক বেশি স্টেডি হতে হবে। তোর মধ্যে এখনও কলেজ স্টুডেন্ট ভাবটা রয়ে গেছে। এইজন্যই হয়তো বিশ্বরূপদাও বেশি বেশি করে তোকে এসব সিচুয়েশনে ফেলে টেস্ট করে যাচ্ছে।”
মানালি বলল, “হুঁ, আমি তো গিনিপিগ। এক আমাকেই পেয়েছে এইসব সিচুয়েশনে ফেলার জন্য। কই বাকিদের তো ফ্যালে না!”
ঋপণ বলল, “জানিস না তবে তুই। প্রান্তিকের ঘটনাটা জানিস তো?”
মানালি মাথা নাড়ল, “কী ঘটনা?”
ঋপণ বলল, “সেই যে সেই মন্ত্রীটার কোরাপশনের নিউজটা জোর করে করাল প্রান্তিককে দিয়ে। প্রান্তিক প্রায়ই থ্রেট খায়। বিশ্বরূপদার কাছে গেছিল। বিশ্বরূপদা ভাগিয়ে দিয়েছে এই বলে যে জার্নোদের ক্ষেত্রে এসব কমন ব্যাপার। অত ভয় খেলে বাড়িতে বসে সাপলুডো খেলো গে যাও।”
মানালি বলল, “প্রবলেমটা তো অন্য জায়গায়। অতই যখন তোমার সাহস তখন নিজের নামে নিউজটা করো না বাপু। আমাদের ফাঁসাচ্ছ কী করতে!”
ঋপণ বলল, “ওখানেই তো কবি কেঁদে দিয়েছে। দেখবি কদিন পরে কোনও প্রাইজ গিভিং সেরিমনিতে ধ্রুব বাগচী আর বিশ্বরূপদা পাশাপাশি বসে চিয়ার্স করছে আর তুই দৌড়ে বেড়াচ্ছিস কেসের ভয়ে। এসবই তো হয় এই লাইনে। কেউ নিজের ঘাড়ে কোনও কিছু নিতে চায় না।”
মানালি বলল, “যে যা পারে করুক, আমার না পোষালে আমি সিম্পলি চাকরি ছেড়ে দেব।”
ঋপণ বলল, “সেই ভালো। সংসার করবি মন দিয়ে।”
মানালি কড়া চোখে ঋপণের দিকে তাকাল। তার ফোনটা বেজে উঠল। মানালি দেখল আননোন নাম্বার। সে ধরল, “হ্যালো।”
“হ্যালো, আমি ট্রিভিয়া মিডিয়া হাউজ থেকে বলছি। মানালি বলছেন?”
মানালি অবাক হল। বলল, “হ্যাঁ, বলছি।”
“একটু হোল্ডে থাকুন ম্যাম, আমাদের স্যার একটু আপনার সঙ্গে কথা বলবেন।”
ফোনের ওপাশ থেকে ইন্টারকমের মিউজিক শুরু হল।
মানালি বলল, “যাহ্বাবা।”
ঋপণ বলল, “কী কেস?”
মানালি ঠোঁট ওলটাল, “কে জানে। কিছুই বুঝছি না।”
ফোনের ওপাশ থেকে এক গুরুগম্ভীর কণ্ঠস্বর ভেসে এল, “মানালি বলছেন?”
মানালি বলল, “হ্যাঁ, কে বলছেন?”
“আমি বিপ্রতীপ রায় বলছি।”
মানালি অবাক হল। বিপ্রতীপ রায়? যার একার নামেই ট্রিভিয়ার নিউজ চ্যানেলটা এত বিখ্যাত? সে বলল, “হ্যাঁ বলুন স্যার।”
“কনগ্র্যাচুলেশনস আজকের নিউজটার জন্য। আজ এই শহরে এই একটাই খবর। আপনি এক্কেবারে বুলস আই হিট করেছেন মানালি।”
মানালি বুঝল না তার এত তারিফ করছেন কেন ভদ্রলোক। শুধু বলল, “থ্যাংক ইউ স্যার।”
“মানালি আপনার স্যালারির তিন গুণ আমরা আপনাকে অফার করছি। আপনি ট্রিভিয়া মিডিয়ায় জয়েন করতে আগ্রহী?”
রাস্তার মাঝখানে হঠাৎ এই প্রস্তাবে মানালির হাত থেকে ফোনটা পড়ে যাচ্ছিল। সকাল থেকে এত টেনশন, তার ওপর হঠাৎ করে এমন প্রস্তাব, সে কোনও মতে নিজেকে সামলাল।
৩১
ন্যাশনাল হাইওয়েতে ঝড়ের বেগে গাড়ি চালাচ্ছিল দীপ। ঘণ্টাখানেক আগে হোটেল থেকে বেরিয়েছে দুজনে।
ঋতি আর গাড়িতে ওঠেনি তার। গাড়িতে বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসেছিল সে।
স্টার্ট যখন দিল তখন আর মাথা কাজ করছিল না।
বেশ কিছুক্ষণ শহরের মধ্যে উদ্দেশ্যহীনভাবে গাড়ি চালিয়ে যখন দেখল বারবার গাড়ি দাঁড় করাতে হচ্ছে জ্যামের জন্য, গাড়ি নিয়ে দ্বিতীয় হুগলি সেতু ধরে দিল্লি রোড ধরে ফেলল। ডানকুনির টোল প্লাজা পেরিয়ে আধ ঘণ্টাটাক চালিয়ে রাস্তার মাঝখানে গাড়ি দাঁড় করাল।
গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার পাশে দাঁড়াল। নিজের ওপর একটা অদ্ভুত রাগ হচ্ছিল তার। বারে বারে মনে হচ্ছিল আদতে সে হেরে গেছে। নিজের কাছে, নিজের ইন্দ্রিয়র কাছে।
ঝড়ের গতিতে এক-একটা গাড়ি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে। দীপ গাড়িতে গিয়ে বসল।
দেখল রাম মিসড কল মেরেছে। কলব্যাক করল সে।
রাম ধরতে বলল, “আজ ডুব মারলি। আবার কোনও চক্করে পড়লি, তাই তো?”
দীপ বলল, “ছিল। আর থাকবে না।”
রাম রেগে গেল, “সে তো সবাই তাই বলে। কাজের সময় দেখা যায় আবার গন্ধ পেলেই পেছন পেছন দৌড়োতে শুরু করবি। কী হয়েছে, খুলে বল।”
দীপ কাটাল, “কাল বলব। ফোনে বলা যাবে না।”
রাম বলল, “কাল কেন? আজ কিঁউ নেহি? কোথায় তুই এখন?”
দীপ বলল, “দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়েতে।”
রাম আঁতকে উঠল, “লড়কি সাথ মে? ক্যা কর রহা হ্যায় বে?”
দীপ বলল, “না না, লড়কি নেই। একাই আছি।”
রাম বলল, “একা একা কী করছিস?”
দীপ বিরক্ত হল, “বললাম তো পরে বলব। রাখ এখন।”
ফোনটা কেটে দিল সে। বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে গাড়ি ঘোরাল। বিকেলের মধ্যে বাড়ি পৌঁছে গেল।
তাকে ঢুকতে দেখে মা বলল, “সে কী রে, আজ সূর্য কোনদিকে উঠেছিল! এত তাড়াতাড়ি চলে এলি!”
দীপ বলল, “ছুটি হয়ে গেল। আমি এখন ঘুমাব। পরে কথা বলছি।”
মা বলল, “এই বিকেলে ঘুমোবি? পাগল নাকি?”
দীপ উত্তর না দিয়ে ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করল। জামাকাপড় পরেই খাটের ওপর শুয়ে পড়ল। অদ্ভুত একটা অস্থিরতা গ্রাস করছিল তাকে। বেশ খানিকক্ষণ পর শুয়ে থেকে যখন বাইরের ঘরে এল, দেখল বাবা মা বসে টিভি সিরিয়াল দেখছে।
বাবা তাকে দেখে বিরক্ত গলায় বলল, “দেখ, বাংলা সিরিয়াল। ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান কিছুই মানে না। এদের ধরে ধরে ম্যাপ পয়েন্টিং করানো উচিত।”