মানালি বলল, “আপনাদের সময়ে সেই সময়ের সবথেকে বড়ো ত্রিকোণ প্রেমের ঘটনা ঘটেছিল। সে ঘটনা আপনাকে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল?”
রত্না বললেন, “মহানায়ক?”
মানালি হাসল।
রত্না বললেন, “সত্যি কথা বলতে কী, ওঁর ত্রিকোণ প্রেম ছিল না। আমরা সবাই ওঁর প্রেমিকা ছিলাম।”
বলেই হেসে ফেললেন রত্না। মানালিও হাসল। বলল, “তা বটে।”
রত্না বললেন, “এই প্রসঙ্গ থাক ভাই। ওঁদের তিনজনই আজ আর আমাদের মধ্যে নেই। অনেক তো হল। আর কত?”
মানালি বলল, “আচ্ছা দিদি। আমি প্রসঙ্গ বদল করছি। অন্য কথা বলি, ধ্রুব বাগচীর সিনেমা যদি আপনি করেনও, সেক্ষেত্রে আপনার অসুবিধে হবে না এতদিন পরে আবার নতুন করে শুরু করতে?”
রত্না বললেন, “হবে না মানে? হবে তো বটেই। কিন্তু কী বলো তো, সাঁতার আর অভিনয় ভোলা যায় না। আমার স্বপ্নে এখনও সে দিনগুলো আসে। কীসব দিন ছিল! একদিকে রাজনৈতিক উথালপাতাল সময়, অন্যদিকে এমন সিনেমা বলো, গান বলো, একের পর এক কিংবদন্তি! এ বলে আমায় দেখ তো ও বলে আমায়!”
মানালি একটু ইতস্তত করে বলল, “ধ্রুব বাগচীকে নিয়ে আজ একটা খবর বেরিয়েছে সময়ের কণ্ঠস্বরে, সেটা পড়েছেন?”
রত্না বললেন, “হ্যাঁ, আমি কাগজ খুঁটিয়েই পড়ি। পড়েছি। আমার কারও ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে তেমন আগ্রহ কোনও কালেই ছিল না। এখন তো আরও চলে গেছে। তবে ধ্রুবর মধ্যে একটা ব্যাপার আছে জানো তো। কারও কারও মধ্যে এই ব্যাপারটা থাকে।”
মানালি অবাক হল, “কী ব্যাপার দিদি?”
রত্না হাসলেন, “কিছু কিছু মানুষকে দেখলে মনে হয় সে লোকটা কিছুতেই ভুল কিছু করতে পারে না। ধ্রুব এক্কেবারে সেই ধরনের মানুষ। আমার কেন জানি না ওকে ভীষণ সৎ মানুষ বলে মনে হয়।”
মানালি বলল, “আপনি ধ্রুবর স্ত্রী ঈপ্সিতার ব্যাপারটা জানতেন?”
রত্না বললেন, “না। জানার চেষ্টা করিনি কোনও দিন। হয়তো ওকে জিজ্ঞেস করলে বলত।”
মানলি বলল, “জানতে চাইবেন এর পরে?”
রত্না মাথা নাড়লেন, “নাহ। কাউকে বিব্রত করতে কোনও কালেই খুব একটা ভালো লাগে না। ধ্রুবর মতো একজন গুণী মানুষকে তো নয়ই। সংবাদপত্র তো লিখবেই। আমরা এই ছায়াছবির জগতের মানুষেরা যদি তাতে প্রভাবিত হয়ে পড়ি তা দুর্ভাগ্যজনক হবে।”
মানালি মুগ্ধ হচ্ছিল। ভদ্রমহিলা বেশি জোরে জোরে কথা বলেন না, বয়সের ভারে অনেকটাই ক্লান্ত, কিন্তু ওঁর মধ্যে একটা অদ্ভুত দৃঢ়তা আছে, অনেকদিন পরে তার মনে হল কাউকে দেখে মাথা নত করাই যায়।
সে বলল, “আপনার কি মনে হয় না রুপোলি জগৎটা খুব দুর্ভাগ্যজনক একটা জগৎ। সম্পর্কের ভাঙা গড়ার জন্য এই জগতের গ্ল্যামার অনেকাংশে দায়ী?”
রত্না হাসলেন, “না। মনে হয় না। সবাই রক্তমাংসের মানুষ। আর পাঁচটা মানুষ যা করে, আমরাও তাই করি। সম্পর্কের ভাঙাগড়া আর পাঁচটা সম্পর্কেও থাকে। আজকাল তো তোমাদের কী সব ফেসবুক না কী এসেছে, আমার ভাইঝি মাঝে মাঝে আমাকে দেখায়, ওখানেই তারা সম্পর্কে জুড়ছে, ওখানেই তাদের বিচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে। তাহলে তো বলতে হয় আধুনিক পৃথিবীটাই দুর্ভাগ্যের জগৎ।”
মানালি পরের প্রশ্ন করতে যাচ্ছিল, এই সময় কলিংবেল বেজে উঠল। রত্না উঠলেন, “দাঁড়াও, ভাইঝি এল বোধহয়।”
রত্না দরজা খুলতে দরজা থেকে যিনি ঘরের ভিতর প্রবেশ করলেন তাঁকে দেখে মানালি আর-একটু হলেই চেঁচিয়ে উঠতে যাচ্ছিল।
ধ্রুব বাগচী!
২৯
“একটা রাত, একটা দিন, আমার দুঃস্বপ্নের মতো কাটল।”
গাড়ি চলছিল। ঋতি কথাগুলো বলে থামল।
পেছন থেকে একটা গাড়ি অনেকক্ষণ থেকে অনাবশ্যক হর্ন বাজিয়ে চলছিল, দীপ সেটাকে সাইড দিল।
শহর থেকে শীত ছেড়ে যাচ্ছে একটু একটু করে। চিরপরিচিত উষ্ণতা গ্রাস করতে শুরু করে দিয়েছে প্রতিটা কোনা।
দীপের হৃৎস্পন্দন বাড়ছিল। পাশে বসে থাকা ঋতির প্রতিটা ছোঁয়া তাকে উত্তেজিত করে তুলছিল।
সে বলল, “আমারও। তোমার কাছে অনেকটা ক্ষমা চাওয়া বাকি আমার।”
ঋতি বলল, “একটা মেয়ে কখনও কাছের মানুষকে কারও সঙ্গে শেয়ার করতে চায় না দীপ। আমি যখনই চিত্রলেখার কাছ থেকে তোমার কথা শুনেছিলাম, আমার মনে হচ্ছিল…” ঋতি কথা শেষ করতে পারল না।
দীপ বলল, “এসব কথা থাক। হোটেল সার্চ করো প্লিজ। অ্যাপটা ওপেন করো।”
ঋতি মোবাইল বের করে হোটেল সার্চ শুরু করল। মিনিট পাঁচেক পর হোটেলের লোকেশন বলে দিল।
জ্যাম বাড়ছে শহরে। দীপের অস্থির লাগছিল। কাজের সময়েই যত বড়ো বড়ো জ্যামগুলো শুরু হয়।
আধ ঘণ্টা লাগল হোটেলে পৌঁছোতে। গাড়ি পার্ক করে তারা রিসেপশনে গেল। দুজনের আই কার্ড নিয়ে বয় রুম দেখিয়ে দিল।
দীপ দেরি সহ্য করতে পারছিল না। রুমের দরজা বন্ধ হতেই ঋতিকে জড়িয়ে ধরল।
ঋতি তাকে ছাড়িয়ে নিল, “একটু ওয়াশরুম হয়ে আসি।”
দীপ বলল, “ওকে ওকে।”
ঋতি ওয়াশরুমে ঢুকল।
দীপের হোটেলের রুমের দিকে চোখ গেল। আট ঘণ্টার স্লটে হোটেল ভাড়া নিচ্ছে সাড়ে তিন হাজার টাকা। সে তুলনায় ঘরগুলো বিরাট কিছু না। একটা বড়ো এলইডি টিভি আছে। দীপ অন্যমনস্কভাবে রিমোট নিয়ে টিভিটা চালাল।
ঋতি বেরোল মিনিট পাঁচেক পরে। দীপ টিভিটা বন্ধ করল।
ঋতি বলল, “টিভিটা বন্ধ করলে কেন? চলুক না!”
দীপ ঋতিকে জড়িয়ে ধরল। পাগলের মতো ঋতির ঠোঁটে চুমু খেতে লাগল।
ঋতি দীপকে দূরে ঠেলে দিল, “প্লিজ, এখন ভালো লাগছে না।”