তাকে দেখে রত্না বললেন, “সময়ের কণ্ঠস্বর?”
মানালি বলল, “হ্যাঁ ম্যাডাম।”
রত্না বললেন, “ভিতরে এসো।”
মানালি ঘরের ভেতর ঢুকল। ঘরময় বাংলা সিনেমার স্বর্ণযুগের ছবি।
সে সোফায় বসে জিজ্ঞেস করল, “আপনি কি একা থাকেন?”
রত্না মাথা নাড়লেন “না, আমার ভাইয়ের মেয়ে থাকে আমার সঙ্গে। এখন কলেজে গেছে। ও লেকচারার।”
মানালি রত্নার দিকে ভালো করে তাকাল। এককালে যে প্রবল সুন্দরী ছিলেন তার রেশ এখনও আছে। তবে বয়স অনেকটাই থাবা বসিয়েছে সত্তরোর্ধ্ব অভিনেত্রীর চেহারায়। চুল সব সাদা। মানালি অনেককেই দেখেছে বয়স হলেও চেহারায় তার ছাপ ফেলতে দেন না। রত্না ব্যানার্জির মধ্যে সেই চেষ্টাটা নেই।
সে বলল, “শুরু করব ম্যাডাম ইন্টারভিউটা?”
রত্না বললেন, “তোমরা কিছু খাবে না?”
মানালি মাথা নাড়ল, “না না ম্যাডাম, ওইসব একদম না। আপনি ব্যস্ত হবেন না।”
রত্না বললেন, “আচ্ছা। তবে শুরু করো। অনেক দিন কেউ ইন্টারভিউ নেয় না। ভুলেই গেছে সবাই।”
মানালি বুঝল রত্নার গলায় অভিমানের ছাপ স্পষ্ট। সে বলল, “শুরু থেকেই বলি? আপনার অভিনয় শুরু কার হাত দিয়ে?”
রত্না বললেন, “তুমি সিনেমার কথা বলছ না মঞ্চের? মঞ্চে আমি বারো বছর বয়েস থেকেই অভিনয় করি। ওখান থেকেই আমায় সিনেমায় নেওয়া হয়েছিল। সে এক সময় ছিল। আমার বাবার তো কিছুতেই মত ছিল না। আমার জ্যাঠামশাই বাবাকে বুঝিয়েসুঝিয়ে রাজি হয়েছিলেন। প্রথম সিনেমা করি ষোলো বছর বয়েসে। “রামের বনবাস”। তারপরেই তো পরপর ডাক পেতে শুরু করলাম।”
ঋপণ উশখুশ করছিল। মানালি বলল, “আপনার ছবি নেবে ম্যাডাম?”
রত্না বললেন, “নাও। আর বারবার ম্যাডাম বোলো না। কেমন কেমন লাগে শুনতে। তুমি আমায় দিদি বলতে পারো। যদিও তুমি আমার নাতনির বয়সি।”
মানালি হাসল, “দিদিটা ঠিক আছে।”
ঋপণ কয়েকটা ছবি তুলল। রত্না বললেন, “কী আর হবে ছবি তুলে। শেষ দিনটার জন্য অপেক্ষা করছি এখন শুধু।”
মানালি বলল, “দিদি, অভিনয়ের প্রশ্ন থেকেই শুরু করি। আপনার স্বামী ফিল্মের বাইরের জগতের একজন মানুষ ছিলেন। ওঁর কোনও দিন আপনার সিনেমা করা নিয়ে আপত্তি ছিল না?”
রত্না বললেন, “সেভাবে ছিল না। বরং উলটোটা বলাই সমীচীন। ও আমাকে বরাবর উৎসাহ দিত। চার বছর আগে এক সকালে হঠাৎ সেরিব্রাল হল। সময় দিল না লোকটা।”
রত্নার চোখে শূন্যতা এল।
মানালি অপ্রস্তুত হল, “দুঃখিত দিদি। আপনাকে আঘাত দিতে চাইনি।”
রত্না হাসলেন, “নাহ, ঠিক আছে। কী আর করবে। সবাইকেই একদিন না একদিন যেতে হবেই। আজকাল আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো? আমরা সবাই এক অদ্ভুত সাজানো পৃথিবীতে বেঁচে আছি। কয়েক সেকেন্ড পরে আমার কী হবে আমরা কেউ বলতে পারি না। এইসব ভেবেই নিজেকে সান্ত্বনা দিয়ে রাখি। একসময় যেভাবে মানুষের চোখে নিজের প্রতি সম্মান দেখেছি, ধীরে ধীরে যখন দেখেছি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সবটাই অবজ্ঞায় পর্যবসিত হয়, তখন প্রথম প্রথম খুব খারাপ লাগত। পরে এসব ভেবেই সামলে উঠেছি।”
মানালি বলল, “অনেকেই তো টিভি সিরিয়ালে কাজ করছেন আপনার সমসাময়িকরা, আপনি করছেন না কেন?”
রত্না বললেন, “পারব না গো। বড়ো পরিশ্রম। অত পরিশ্রম এখন আর হয়ে উঠবে না। আমাকে এক প্রোডাকশন হাউস থেকে বলেছিল। আমি না করে দিয়েছি। তবে ধ্রুব, চেনো তো নিশ্চয়ই, ধ্রুব বাগচী, ওর একটা সিনেমায় আমাকে অফার করেছে একটা খুব গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। আমাকে ও বলেছে কোনও সমস্যা নেই নাকি, বাড়ি নিয়ে যাওয়া, বাড়ি দিয়ে আসা, সব কিছু নাকি ও নিজে দেখবে। আমি না করা সত্ত্বেও জোর করে এই সিনেমাটা আমাকে দিয়ে করাতে চায়। আমি ওকে এও বলেছি, সিনেমার মাঝপথে যদি আমার কিছু হয়ে যায় তখন কী হবে? শুনে ছেলে তো একবারে রে রে করে উঠল। এখন এই নিয়েই ভাবছি। করব কি না। করলে প্রায় পনেরো বছর পরে স্ক্রিনে ফেরা। সঙ্গে কত ঝক্কি!”
মানালি মনে মনে কপালে হাত দিল। এখানেও ধ্রুব বাগচী! তার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে বিশ্বরূপদা সব জেনে বুঝেই এই খবরটা করতে তাকে পাঠিয়েছে।
মানালি বলল, “আপনি সাম্প্রতিক কালের সিনেমা দেখেন?”
রত্না বললেন, “কয়েকটা দেখেছি। সাউথের রিমেকগুলো ইচ্ছা করেই আর দেখতে যাই না। ওরকম সিনেমা আমাদের ভালো লাগবারও কথা নয়। বড়ো পীড়াদায়ক জানো তো! এককালে এই বাংলা থেকে কত বড়ো বড়ো সাহিত্যিকের লেখা নিয়ে সিনেমা হত। তারাশঙ্কর, আশুতোষ কিংবা রবীন্দ্রনাথের দেশে যে দক্ষিণ থেকে গল্প টুকে নিয়ে এসে সিনেমা বানাতে হচ্ছে এই ভাবনাটাই বড়ো কষ্ট দেয় আমায়। এর বাইরে যে সিনেমাগুলো হচ্ছে তার বেশ কয়েকটা দেখেছি। কয়েকটা মনে হয়েছে বড়ো তাড়াহুড়ো করে বানানো। কয়েকটা দেখে মনে হয়েছে একটু বেশি স্মার্টনেস দেখাতে গিয়ে গল্পটা আর সামলে উঠতে পারেনি। তবে এখন তো সবটাই বাজারনির্ভর। বাজার যেভাবে ঠিক করে দেয়, মানুষের স্বাদ সেভাবেই তৈরি হয়। আমাদের পছন্দ অপছন্দে কার কী যায় আসে বলো?”
মানালি বলল, “রাস্তাঘাটে বেরোলে মানুষজনের সাড়া কেমন পান?”
রত্না ম্লান হাসলেন, “বেশিরভাগই চেনে না। যারা চিনতে পারে সেলফি নিতে চলে আসে। এই এক নতুন কায়দা হয়েছে তোমাদের প্রজন্মের। মানুষ যেখানে যাচ্ছে সেলফি তুলছে। অথচ জানো, আমার মনে পড়ে, আমরা যখন প্রথম ক্যামেরা কিনেছিলাম তখন কী অবস্থা ছিল? আমার উনি, দিল্লি থেকে নিয়ে এসেছিলেন। আগফা। এই কবছরে কত কিছু পরিবর্তন হয়ে গেল।”