ধ্রুব কফি মাগ মানালির দিকে এগিয়ে সোফায় বসে বললেন, “আপনাদের জেনারেশনের সমস্যাটা কী জানেন? আপনারা কোনও কিছু করার আগে সামনে পিছনে চিন্তা করেন না। তারপরে হঠাৎ করে হুড়কো খেয়ে গেলে খোলা বাজারে দৌড়ে বেড়ান। সত্যিটার মুখোমুখি হতেই বা এত ভয় কীসের? ফোনটা অফ করে রেখেছেন কেন?”
মানালি কিছু বলতে পারল না। ফ্যাকাশে হাসল।
ধ্রুব কফি মাগে চুমুক দিয়ে বললেন, “আমরা মানুষের প্রাইভেসিকে সম্মান করতে জানি না। আমাদের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে একজন লেখক, একজন শিল্পীর থেকে অনেক বেশি দাম পায় একজন তৃতীয় শ্রেণির সিরিয়াল অভিনেতা, যে কতগুলো শেখানো বুলি কপচে অভিনয় করে চলে আসে। কেন জানেন? আমরা মেধার সম্মান দিতে জানি না। শুধু তাই নয়, এ দেশে একজন স্টার মানে আমরা যতক্ষণ না তাদের ঘরের ভিতর উঁকি না মেরে দেখতে পারছি, ততক্ষণ আমাদের কোনও শান্তি হয় না।”
মানালি বলল, “আমি বুঝতে পারছি আপনি কী বলতে চাইছেন।”
ধ্রুব একটা সিগারেট ধরালেন, বললেন, “শুধু আপনি কেন, যে-কোনো সেন্সিবল মানুষই বুঝতে পারবে, কিন্তু তাতে কি কোনও লাভ হবে? আপনি আমাকে জাস্ট একটা কথার উত্তর দিন, আজকের নিউজটা বেরোনোর পরে কার কী এমন লাভ হবে? ক্ষতিটা তো একটা মেয়ের হবে, যে দাঁতে দাঁত চেপে একটা পিছিয়ে পড়া জায়গার কতগুলো অনাত্মীয় ছেলেমেয়ের জন্য লড়ে যাচ্ছিল। সম্পর্ক বলতে কি একসঙ্গে থাকাটাকেই বোঝেন আপনারা?”
মানালি মাথা নিচু করে বলল, “সম্পূর্ণ সিদ্ধান্তটাই বিশ্বরূপদার… আমি আর-একবার বলছি। তা ছাড়া নিউজটা এত তাড়াতাড়ি বেরিয়ে যাবার কথাও ছিল না। আমি যদি জানতাম স্টোরিটা কবে বেরোবে, তার আগে নিশ্চয়ই আপনাকে জানিয়ে দিতাম।”
ধ্রুব মাথা নাড়লেন, “একটা যুদ্ধ হবে। একটা বড়ো যুদ্ধ শুরু হবে। আপনাকে না চাইলেও হয়তো একটা পক্ষে থাকতে হবে। আপনি জানেন আজ সকাল থেকে কটা পেপার আমাকে ফোন করেছে?”
মানালি উত্তর দেবার আগেই কলিং বেল বেজে উঠল। ধ্রুব দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, “এই যে, এসে গেছে কোনও চ্যানেল। কেচ্ছার খোঁজে খোঁজে। কেচ্ছায় কেচ্ছা বাড়ে। দেখবেন কাল অন্য কোনও পেপারে আমার সম্পর্কে আরও নতুন নতুন কেচ্ছা জানতে পারবেন। এঁরা মাইনেই পান লোকের গায়ে কালি ছিটিয়ে দেওয়ার জন্য। যে কথা কেউ কোনও দিন বলেনি, সে কথাও কারও মুখে বসিয়ে দিতে এঁরা দুবারও ভাবেন না।”
ধ্রুব উঠলেন, দরজা খুললেন।
মানালি দেখল দুজন ধ্রুবর পিছন পিছন ড্রয়িং রুমে ঢুকল। দুজনের কাউকেই সে চিনতে পারল না।
ধ্রুব বললেন, “বসুন, আপনারাও বসুন। আমরা কি আরও কয়েকটা চ্যানেল আসার জন্য অপেক্ষা করব?”
দুজনের মধ্যে একটা ছেলে মাথা নাড়ল, “না স্যার, প্লিজ, আমরা আগে এলাম, আমাদের একটু অ্যাটেন্ড করুন।”
ধ্রুব বললেন, “এক্সক্লুসিভ নিউজ? সে তো আজকে বেরিয়েই গেছে সময়ের কণ্ঠস্বরে।”
সেই প্রথমজনই বলল, “স্যার, একটা জিনিসই জাস্ট জানার, ওই নিউজে যা যা লেখা হয়েছে সবই কি সত্যি?”
ধ্রুব বললেন, “আংশিক। পৃথিবীতে কোনও কিছু একশো শতাংশ খাঁটি হতে পারে না।”
দ্বিতীয়জন বলল, “স্যার শ্রীপর্ণা ম্যাডামকে আমরা ফোন করেছিলাম, উনি সব অ্যাবসার্ড বলে উড়িয়ে দিয়েছেন।”
ধ্রুব বললেন, “সেটা তো বলাই স্বাভাবিক। বন্ধুত্বর সম্পর্ক আপনারা বোঝেন না।” ধ্রুব একবার মানালির দিকে তাকিয়ে আবার ছেলেদুটোর দিকে মনোযোগী হলেন, “আপনারা এবার আসুন। এই ব্যাপারে আমার একটাই বক্তব্য। নো কমেন্টস।”
ছেলেদুটো পরস্পরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করল।
ধ্রুব বললেন, “খাজনার থেকে বাজনা বেশি হয়ে গেছে ইন্ডাস্ট্রিতে। কে কেমন সিনেমা বানাচ্ছে তা নিয়ে কিন্তু বিন্দুমাত্র কারও উৎসাহ নেই। শুধু কে কার সঙ্গে শোবে, কে কবে কী গোপন কথা কাকে বলেছিল, সেসব নিয়ে কন্টিনিউয়াস হ্যাজ হয়ে যাচ্ছে। ওরা যা ইচ্ছা লিখুক।”
প্রথম ছেলেটা বলল, “স্যার আপনার মনে হয় না এই কন্ট্রোভার্সিটা সামনে আসার ফলে আসলে আপনার লাভই হল? আপনার বাজারটা পড়ে যাচ্ছিল, অনেকটা বুস্ট আপ হল সম্প্রতি।”
ধ্রুব আর-একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, “যে বাজার লোকের ঘরকে পৃথিবীর সবার সামনে তুলে ধরতে বিন্দুমাত্র ভাবে না, যে বাজার মানুষের প্রাইভেসিকে বিন্দুমাত্র সম্মান দেয় না, সে বাজারের মুখে আমি মুতি। বুঝলেন?”
ছেলেদুটো এবার একরাশ অস্বস্তি নিয়ে মানালিকে দেখে বলল, “তবে আমরা আসি স্যার।”
মানালিও উঠল। বলল, “আসছি স্যার।”
ধ্রুব হাত নাড়লেন। মানালির খানিকটা অপমানিত লাগছিল। সঙ্গে নিজের প্রতি রাগও হচ্ছিল। কোনও দরকার ছিল না এরকম ঝোঁকের মাথায় ধ্রুব বাগচীর বাড়ি চলে আসার। ব্যাপারটা সবাই জানলে আরও বেশি খিল্লি হতে পারে। বিশ্বরূপদা রেগেও যাবে ভীষণ।
ধ্রুবর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নামতেই দুজন ছেলের একজন তাকে জিজ্ঞেস করল, “আপনিও প্রেস?”
মানালি অন্যমনস্ক ভাবে বলল, “সময়ের কণ্ঠস্বর।”
দুটো ছেলেই মানালির দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে প্রায় একসঙ্গে বলল, “আপনিই রিপোর্টটা করেছেন?”
মানালি বলল, “হ্যাঁ।”
দুজন মুখ চাওয়াচাওয়ি করল আবার।
মানালি দাঁড়াল না। ট্যাক্সি দাঁড়িয়ে ছিল একটা। উঠে অফিসের অ্যাড্রেস বলে দিল।