যে রকম আনন্দে মুখ উজ্জ্বল হয়েছিল মরনির এখন ঠিক সেই ভঙ্গিতেই ম্লান হল। ক্যা রে বাজান? আফাজদ্দি খলিফা তরে হুইতে দেয় না, খাইতে দেয় না? এর লেইগা তুই এমন কাহিল হইয়া গেছচ, হুগাইয়া (শুকিয়ে) গেছচ!
কেডা কইলো আমি হুগাইছি! তোমার চোক্কে তো আমি সব সমায়ঐ হুগনা। হোনো, খলিফা কাম করতে অয় রাইত দোফর পইরযন্ত। রাইত দোফরে হুইয়া ওটতে অয় ফয়জরের আয়জানের লগে লগে। এক মাতারি (মহিলা) বাসা থিকা ভাত রাইন্দা আইন্না বেবাক কর্মচারিগো খাওয়ায়। গুড়াগাড়ি (ছোট ছোট) মাছ আর ডাইল। রান্দন যে মাইনষের এত খারাপ অইতে পারে, ইস কী কমু তোমারে! মুখে দেওন যায় না।
তাইলে ঐ মাতারির রান্দন খাচ ক্যা?
কী করুম, বেবাকতে খায়! আফাজ মামার ঠিক করা মাতারি, হে খাওনের টেকা দেয়, তার ইচ্ছায়ঐত্তো খাওন লাগবো! খলিফা কামে পয়লা পয়লা থাকন খাওন খারাপঐ অয়। ছোট্ট একখান ঘরে চিপাচিপি (গাদাগাদি) কইরা হুইতে অয় দশ বারোজন মাইনষের। ওমনে হুইলে ঘুম আহে, কও! তয় খলিফা অইতে পারলে আইজ কাইল লাব আছে। টাউনে বিরাট বিরাট গারমেন হইতাছে। তিন চাইর হাজার টেকা এহেকজন খলিফার মায়না। দুইয়েক বচ্ছর বাদে আমিও ঐরকম গারমেনে চাকরি লমু! তহন বড় খলিফা অইয়া যামু।
গারমেন কী রে বাজান?
জামা কাপোড়ের কারখানা। এইদেশ থিকা জামা কাপোড় বানাইয়া লন্ডন আমরিকায় পাড়ায়।
একটু থেমে মজনু বলল, গারমেনে চাকরি লইয়াঐ টাউনে একখান বাসা ভাড়া লমু। তোমারে লইয়া যামু। তহন তোমার আর এত কষ্ট করন লাগবো না। অহনও কোনও চিন্তা তুমি কইরো না। পয়লা তিনমাস পেডেভাতে কাম হিগছি। একমাস ধইরা দুইশো টেকা মায়না পাই। পনচাস টেকা আমার পকেট খরচার লেইগা রাইক্কা দেশশো টেকা কইরা মাসে তোমারে পাডামু। কহেক মাস বাদে যহন চাইরশো টেকা মায়না অইবো তহন পাডামু তিনশো কইরা। এইদিন থাকবো না খালা, দিন বদলাইবো।
কথা বলতে বলতে শার্টের বুক পকেট বরাবর একটা বোতাম খুলল মজনু, বুকে হাত দিল। মরনি অবাক হয়ে মজনুর দিকে তাকাল। কী অইলো বাজান, পিপড়ায় কামোড় দিছে?
মজনু হাসল। না, শাডের ভিতরে একখান জেব (পকেট) আছে। টেকা পয়সা হেই জেবে রাখি।
হাত বের করল মজনু। হাতে অনেকগুলি কড়কড়া দশ টাকার নোট। এত টাকা মজনুর হাতে দেখে অবাক হয়ে গেল মরনি। টাকার দিকে তাকিয়ে রইল।
মজনু বলল, আমার পয়লা মাসের মায়নার টেকা। লঞ্চ ভাড়া দিয়া একশো ষাইট টেকা আছে। নেও ধরো।
তখনও অবাক ভাব কাটেনি মরনির। ঘোর লাগা ভঙ্গিতে হাত বাড়িয়ে টাকা নিল। কোন ফাঁকে চোখ ভরে গেছে পানিতে, টের পায়নি। গাল বেয়ে চোখের পানি নামল মরনির। তবু মুখখানা হাসিমাখা। একহাতে চোখের পানি মুছে টাকাটা সে একবার বুকে ছোঁয়ায়, একবার কপালে। মুখে কথা নাই।
খালার এই অবস্থা দেখে মুগ্ধ হল মজনু। বলল, চাইছিলাম শতেকখানি টেকা দিয়া তোমার লেইগা একখান কাপোড় কিন্না আনি। পরে মনে করলাম টেকাডাঐ আইন্না তোমার হাতে দেই। আমার পয়লা রুজি দেইক্কা খুশি অইবা তুমি। ও খালা, খুশি অও নাই, খুশি অও নাই তুমি?
আবার চোখ ভরে পানি এল মরনির। তবে মুখে আনন্দের হাসিখানা লেগেই আছে। ঠেলে ওঠা কান্না বুকে চেপে বলল, বহুত খুশি অইছি, বহুত খুশি অইছি বাজান। পোলার পয়লা রুজির টেকা হাতে লইছি, আমার থিকা সুখি মা আর কে আছে দুইন্নাইতে। এই টেকা থিকা পাচটেকার সিন্নি দিমু খাইগো বাড়ির মজজিদে (মসজিদ)। মুন্সি সাবরে দিয়া মলুদ শরিফ (মিলাদ) পড়ামু। আল্লায় যে আমার মনের আশা পূরণ করছে, আল্লার কাছে হাজার শুকরিয়া, লাক লাক শুকরিয়া।
একহাতে মজনুর মাথাটা বুকের কাছে টেনে আনল মরনি। তরে ছাইড়া থাকতে কেমুন কষ্ট যে আমার অয়, বাজানরে, আল্লা ছাড়া কেঐ জানে না। খাইতে বইলে মনে অয়, তুই ভাত খাইছসনি! ঘুমাইতে গেলে মনে হয়, তুই কেমতে হুইয়া রইছস, কেমতে ঘুমাইছস! আমার রাইত কাইট্টা যায় তর কথা চিন্তা কইরা। খালি মনে অয় আমার বুকের মানিক কই পইড়া রইছে আর আমি কই। তর কষ্টে আমার বুক ফাইট্টা যায় বাজান।
খালার বুকের কাছে মুখ রেখে মজনু বলল, আমারও তোমার মতনঐ অয় খালা। আমারও তোমার লেইগা মনডা কান্দে। তোমার মুকহান দেহনের লেইগা মন ছুইট্টা যায়।
তরে আমি খলিফা কামে ক্যান দিছি জানচ! ক্যান আমগো গেরামের আফাজদ্দি খলিফা দেশে আহনের পর তারে গিয়া কইছিলাম, আমার পোলাডারে আপনের কাছে লইয়া যান, অরে কাম হিগান, খলিফা বানান।
ক্যান কইছিলা খালা?
তর মায় মরণের পর থিকা তুই আমার কাছে। তরে আমি মাডিতে হোয়াই নাই পিপড়ার ডরে, মাথায় রাখি নাই উকুনের ডরে। তবে আমি রাখছি আমার বুকে। হেই বুকের ধন দূরে ঠেইল্লা দিলাম খালি একখান্ কথা চিন্তা কইরা। খেতখোলার কাম, গিরস্তালি তুই করতে পারবি না। তর শইল্লে কুলাইবো না। তুই এমুন একখান কাম হিগবি, জীবন ভইরা এমুন একখান কম করবি, যেই কাম সোন্দর কাম। হাত পায়ে প্যাককেদা লাগে না, কহর পড়ে না। যেই কাম ভাল কাপোড় জামা ফিন্দা করন যায়। যেই কাম অন্য মাইনষেরেও সোন্দর করে। অন্য মাইনষের শইল্লে বসন তুইল্লা দেয়। ঢাকা থিকা ভাল জামা কাপোড় ফিন্দা যে কোনও মানুষ ফিরত আইলে তারে দেইক্কা য্যান তর কথা মনে অয় আমার। য্যান মনে অয় এই জামা কাপোড় আমার মজনুর হাতে বানানো, আমার বাজানের হাতের পরশ আছে দেশের বেবাক সোন্দর সোন্দার জামা কাপোড়ে।