নূরজাহান কোনও কথা বলল না। কিরনীর কথাবার্তা শুইনা মানুষটারে তার ভাল লাগল। শয়তান বদমাইশ না। মনের মইদ্যে প্যাঁচিঘুচি নাই।
অনেকক্ষণ কথা বলে ক্লান্ত হইয়া গেছে কিরনী। হাঁপাচ্ছিল। সেই অবস্থায় মেয়েদের ডাকল। রওশন, ও রওশন, আয়শা খোদেজারে লইয়া এই ঘরে আয় মা। তাড়াতাড়ি আয়।
তিন মেয়ে দৌড়াইয়া আইসা ঢুকল বড়ঘরে। রওশন বলল, কীর লেইগা ডাক পাড় মা?
তরা আমার কাছে আয়।
তিনজন কিরনীর গা ঘেঁইযা দাঁড়াইল। কিরনী নূরজাহানরে বলল, তোমার হাত দুইডা দেও বইন।
নূরজাহান কিছু বুঝতে পারল না। তবু হাত দুইটা বাড়ায়া দিল। তিনটা মেয়ের হাত একলগে কইরা নূরজাহানের হাতের উপর রাখল কিরনী। আইজ থিকা আমার এই মাইয়া তিনডা তোমারে দিয়া দিলাম বইন। আমার মাইয়া তিনডা আইজ থিকা তোমার মাইয়া। আমি তো পারি নাই, তুমি অগো মানুষ কইরো বইন। তুমি অগো আপনা মাইয়া মনে কইরা মানুষ কইরো। আমার মাইয়াডি য্যান নষ্ট না অয়, আমার মাইয়াডি য্যান ভাল মাইয়া অয়। দেশগেরামের মাইনষে য্যান কয় মতলিবের মাইয়া তিনডা বহুত ভাল। আমার এই কথাডা। তুমি রাইখো বইন।
কথা বলতে বলতে কেঁদে ফেলল কিরনী। নুরজাহান অপলক চোখে তার মুখের দিকে খানিক তাকায়া রইল তারপর মেয়ে তিনটাকে নিজের কোলের কাছে টাইনা আনল। দুই হাতে বুকের কাছে একলগে প্যাচাইয়া ধরল তিনজনরে। আপনে চিন্তা কইরেন না বুজি। আইজ থিকা অরা আমার মাইয়া। আমি বাঁইচা থাকতে অগো খারাপ হইতে দিমু না। অগো আমি মানুষ করুম। আপনে যেমুন আমারে বইন কইছেন, আমিও আপনেরে আমার বড় বইন মানলাম। আপনে আমার বুজি। খালি মাইয়াগো না, আমার বুজির দায়িত্বও আমার। আপনের মাইয়া গো বাপের দায়িত্বও আমার।
কিরনী আবার কেঁদে ফেলল। বহুত খুশি হইলাম বইন, বহুত খুশি হইলাম। আমি দোয়া করি, আল্লায় সারাটা জীবন য্যান তোমারে ভাল রাখে। জিন্দেগিতে যেই দুঃখ কষ্ট তুমি পাইছো হেই দুঃখ কষ্ট য্যান আর কোনওদিন না পাও। বাকি জীবন তোমার য্যান সুখে কাটে, শান্তিতে কাটে।
পরদিন থেকে মতলিবের পুরা সংসার নূরজাহানের কান্ধে।
ফজরের আজানের লগে লগে ঘুম থিকা উঠল সে। উইঠা নিজের কামকাইজ সাইরা কিরনীরে ঘর থিকা বাইর করল। তারে ধইরা ধইরা লইয়া গেল পায়খানায়। ছোট্ট শিশুকে যেমন কইরা পায়খানা পেশাব করায় মা, পয়পরিষ্কার করায় ঠিক সেইভাবে তার কাজগুলি করাইল। তারপর মাইয়া তিনটারে উঠাইয়া প্রত্যেকের হাতে চুলার ছাই দিল ভাল কইরা দাঁত মাজনের লেইগা। রওশন বড়, তারে শিখাইয়া দিল ছোট দুই বোনরে কীভাবে কোন কাজে সাহায্য করতে হয়। তারপর গিয়া ঢুকল রান্ধনঘরে। চটপটা হাতে বউয়া রানল। মতলিবের সেই দুই আত্মীয় মহিলা তখন গাঠঠি বোঁচকা লইয়া মেলা দেওনের চিন্তায়। তাগো খাওয়াইয়া দাওয়াইয়া বিদায় করল নূরজাহান। যাওয়ার সময় তারা মতলিবের কাছে বিরাট সুনাম কইরা গেল নূরজাহানের। তোমার কপাল ভাল মতলিব, এই বয়সে এমুন বউ পাইছো।
মতলিবের টিবিনকারিতে ভইরা তার দুপুরের খাবার দিল। দুপুরের দিকে তিন মেয়েকে প্রথমে গোসল করাল, মাথায় তেল দিয়া, মাথা আঁচড়াইয়া, ধোয়া ফ্রক পরাইয়া, হাতে পায়ে। তেল দিয়া চেহারা বদলাইয়া ফালাইল মেয়ে তিনটার। তারপর কিরনীকে উঠানে আইনা একটা ছপে (মাদুর) বসাইয়া বড়ঘরের বিছনা বদলাইল। আলমারিতে রাখা পরিষ্কার কথা চাদর বিছাইল খাটে, বালিশে ওসার (ওয়্যার) বদলাইয়া ঘর থেকে বোটকা গন্ধ দূর কইরা ফালাইল। একদিনে কুলাইতে পারব না দেইখা পরদিন কিরনীর ঘরের চাদর কথা, পুরানা বালিশের ওসার এইসব গরম পানি সোডা দিয়া ধোয়ার জন্য রাইখা দিল।
মতলিব রাতেরবেলা বাড়ি আইসা দেখে একদিনে তার সংসারের চেহারা অনেকখানি। বদলাইয়া গেছে। দিন চার-পাঁচেকের মধ্যে দেখে পুবের ঘর বাংলাঘরের মেঝে লেপাপোছা, পাটাতন ঘরের কাঠগুলি ঝকঝকা। বাড়ির উঠানে একটা পাতা পইড়া নাই, এককণা ধূলা নাই। রান্ধনঘরটা পরিষ্কার, চাপকলতলা পরিষ্কার। পায়খানার ওদিক থেকে সারাদিন। হাওয়ার লগে আসত মলের গন্ধ। চুলার ভিতরে জইমা থাকে ছাই গোড়া ভইরা তুইলা পায়খানায় ফালাইছে নূরজাহান। ফলে গন্ধটা আর নাই। বাড়িটা একেবারেই অন্যবাড়ি।
এই কয়দিনে মতলিব তো নূরজাহানের ব্যাপারে মুগ্ধই, কিরনীর মুগ্ধতার কোনও সীমা পরিসীমা নাই। সব থেকে বেশি খুশি মেয়ে তিনটা। তারা ছোটমা ছাড়া কিছু বোঝেই না। নূরজাহানের পায়ে পায়ে ঘোরে।
সাতদিনের দিন মতি মাস্টারকে খবর দিয়া আনা হইল বাড়িতে। তিনি সন্ধ্যাবেলা আইসা মতলিবের তিন মেয়েকে পড়াবেন। তাদের বইখাতা কী কী লাগবে সেইসবের জন্য টাকা দেওয়া হল তাকে। তিনি নিজেই ওইসব কিনা আনবেন। লগে কায়দা সিপারাও আনবেন দিঘলি বাজার থেকে। সকালবেলা মেয়েদেরকে আরবি পড়াবেন আমিন মুনশি আর সন্ধ্যাবেলা বাংলা ইংরাজি অঙ্ক এইসব পড়াবেন মতি মাস্টার। মাস্টারের বেতন মাসে দেড়শো টাকা। আমিন মুনশি নিবেন একশো টাকা।
টাকাপয়সার কথা শুইনা মতলিব একটু কথা বলতে চাইল। অহন বইখাতা কিনন, তারবাদে মাসে মাসে এতডি টেকা। মাইয়াগো পড়ালেখা করাইয়া লাভ কী?
নূরজাহানের কিছুই বলতে হল না, কিরনীই স্বামীকে একটা ধমক দিল। কোনও কথা কইবা না। নূরজাহান যেমতে মাইয়াগো মানুষ করতে চায় তারে ওইডা করতে দেও। টেকা পয়সা যা খরচা হয় করবা! কোনও কিরপিনপানা করবা না, খবরদার! নূরজাহান হইল এই বাড়ির লক্ষ্মী। অহন থিকা অর নূরজাহান নামের লগে লক্ষ্মী নামটাও থাকবো। আমি অরে লক্ষ্মী বইলাই ডাকুম। আমার মাইয়ারা ডাকবো লক্ষ্মীমা।