‘এত রাতে কোথায় পাব জানাবার লোক? তা ছাড়া জানাতে যাবই বা কেন?’ বলে গাড়ি ছেড়ে দিল রানা। ভাবছে, কখন জানি রেগে গিয়ে মেরে বসে লোকটা!
শহরতলির শেষ প্রান্তে পৌঁছে বাঁক নিয়ে একটা খোয়া বিছানো, সরু, নির্জন রাস্তায় ঢুকল রানার গাড়ি। কিছুদূর গিয়ে থেমে দাঁড়াল ঝোপঝাড়ের পাশে।
‘থামছেন যে?’ জানতে চাইল ক্লিপটন। ‘রাস্তার মাঝখানে থেমে দাঁড়াচ্ছেন কেন?’
আড়চোখে রানা দেখল, গ্লাভ পরা হাত দুটো কোলের উপর রাখা। একটু যেন বেশি শান্ত লাগছে লইয়ারকে। রানা ভাবল, ওর যদি কোথাও কোনও ভুল হয়ে থাকে, তা হলে বেইজ্জতির সীমা-পরিসীমা থাকবে না। ‘কথা আছে,’ বলল ও। ‘আপনি আমাদেরকে কাজ দিয়েছিলেন আপনার একজন মক্কেলকে খুঁজে দেবার জন্যে, যাকে হারিয়ে ফেলেছিলেন আপনি। আমরা আপনার সে-কাজটা করে দিয়েছি। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, ব্যাপারটা গড়িয়েছে গিয়ে খুনে। খুন হয়ে গেছে লোকটা!’
‘এই কথা বলতে এত রাতে আমাকে ঘুম থেকে তুলে এনেছেন, রানা? স্ট্যানলির সঙ্গে কোথাকার কোন্ মিসেস শেফার্সের গোপন প্রেম ছিল কি ছিল না, কেন সে স্ট্যানলিকে খুন করল; এসবের সঙ্গে আমার বা আপনার কী সম্পর্ক?’
‘আপনার কথা বলতে পারব না, ক্লিপটন, কিন্তু আমার সম্পর্ক আছে। আপনিই জড়িয়েছেন আমাকে। আমি আপনাকে বলেছি, কাজটা আমাদের লাইনে পড়ে না, আর কাউকে দিন-আপনি জোর করে চাপিয়েছেন ওটা রানা এজেন্সির ঘাড়ে; কেন তা আপনিই বলতে পারবেন। তখন জানতাম না, এভাবে খুন হয়ে যাবে আমাদের টার্গেট।’
‘আপনার বক্তব্য আমার কাছে পরিষ্কার হচ্ছে না, রানা। মনে হচ্ছে, মেয়েলোকটার হাতে স্ট্যানলির খুন হয়ে যাওয়াটা, আপনার ধারণা, আমি ঠেকাতে পারতাম!’
‘ক্লিপটন, ও এই খুনটা করেনি। ওর টেলিফোনে আমরা আড়ি পাতা যন্ত্র ফিট করেছিলাম। গতকাল সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রিটা শেফার্স-এর ফোনে যে যা বলেছে, সব রেকর্ড করা আছে আমাদের টেপে। পেছনের সিটেই রাখা আছে রেকর্ডারটা, আপনি চাইলে আমি বাজিয়ে শোনাতে পারি। পুলিশের মেডিকেল এগজামিনার স্ট্যানলির মৃত্যুর সময় নির্ধারণ করেছেন: দুপুর তিনটে থেকে তিনটে দশ। আমার টেপ বলছে তিনটের সময় পিজিয়ন লেনের বাড়ি থেকে টেলিফোনে কথা বলছিল মিসেস শেফার্স স্ট্যানলির সঙ্গে, ঠিক সেই সময়েই গুলির শব্দ হয়। বুঝতে পারছেন? দশ মিনিটের মধ্যে ম্যানহাটনে পৌঁছানো সম্ভব ছিল না ওর পক্ষে। রিটা শেফার্সের অকাট্য অ্যালিবাই রয়েছে আমার টেপে।’ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল রানা। লক্ষ করল উকিলের হাত দুটো এখনও কোলের উপর রাখা। ‘গুলিটা করে আপনি মারলিন হোটেলের ওই কামরাতেই ওঁৎ পেতে অপেক্ষায় ছিলেন মেয়েটির জন্যে-জানতেন ও আসছে। মেয়েটি যখন পাগলের মত কামরায় ঢুকল, আপনি মাথায় বাড়ি মেরে অজ্ঞান করে পিস্তলটা ধরিয়ে দিলেন ওর হাতে। তারপর নিশ্চিন্তে বেরিয়ে গিয়ে পুলিশকে খবর দিলেন, একটা গুলির আওয়াজ শোনা গেছে মারলিন হোটেলের দোতলা থেকে। পুলিশও গিয়ে হাতে-নাতে ধরল ওকে। আপনার খুনের দায় চাপল রিটার কাঁধে।’ হাসল রানা, ‘এবার কিছুটা পরিষ্কার হয়েছে, জনাব?’
শান্ত ভঙ্গিতে বসে আছে লইয়ার। তার মনের ভিতর কী চলছে, সে-ই বলতে পারবে। পাশ ফিরে চেয়ে রয়েছে রানার মুখের দিকে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করছে রানার আসল উদ্দেশ্যটা কী। আড়চোখে আর একবার ওর হাতের দিকে তাকাল রানা-অলস ভঙ্গিতে রাখা ও দুটো কোলের উপর। ‘উদ্ভট এক গল্প ফেঁদেছেন, রানা,’ বলল সে কিছুক্ষণ পর। ‘আপনার ইচ্ছেটা কী? কোনও ধরনের ব্ল্যাকমেইল?’
‘আমি কি আপনার কাছে টাকা-পয়সা চেয়েছি, ক্লিপটন?’ মাথা নাড়ল রানা। ‘আপনি জানেন, আমরা সবসময় ন্যায়ের পক্ষে কাজ করতে চেষ্টা করি। কোনও বদমাইশ অনর্থক কাউকে খুন করে সে-খুনের দায় অন্যায়ভাবে চাপিয়ে দেবে নিরীহ একটা মেয়ের ওপর, আর আমরা চুপচাপ সেটা চেয়ে চেয়ে দেখব-বাংলাদেশের মানুষ আমরা অতটা হৃদয়হীন, পাষণ্ড নই, ক্লিপটন। আমরা আপনাকে সাবধান করিনি একথা বলতে পারবেন না। তারপরেও কাজটা আপনি আমাদের ঘাড়ে চাপালেন। আপনার জানা উচিত ছিল, মক্কেল সম্পর্কে খোঁজ নেয়াও আমাদের কাজের মধ্যে পড়ে। যখন জানলাম, আপনি দেউলিয়া হওয়ার পথে, শেয়ার ব্যবসায় মার খেয়ে আর্থার হেনরির ফাণ্ড থেকে কয়েক দফায় মোটা অঙ্কের টাকা তুলে ফেঁসে গেছেন, তখন ভাল করে নজর দিতেই হলো। উত্তরাধিকারীরা টাকার জন্যে চাপ দিচ্ছে, দেবেই, টাকাটা ওদের। স্ট্যানলিকে পাওয়া যাচ্ছে না, একথা বলে বহুদিন ওদেরকে ঠেকিয়ে রেখেছিলেন এই ভেবে যে, আপনার কাকা মারা গেলে তার টাকা দিয়ে ফাণ্ড পূরণ করে দেবেন। কিন্তু কাকা আর মরে না। তারপর ওরা যখন নিজেরাই স্ট্যানলির খোঁজ বের করে দিল, তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে বাধ্য হলেন আপনি অনিচ্ছাসত্ত্বেও। কিন্তু প্লেনটা ক্রাশ করল। ভাবলেন, বাঁচা গেল বুঝি; কিন্তু না, জানা গেল জীবিত তিনজনের মধ্যে রবার্ট স্ট্যানলিও একজন। ওকে গায়েব করে দিয়ে বা খুন করে বাঁটোয়ারা পিছিয়ে দেওয়ার প্লান ছিল আপনার আগে থেকেই। কিংবা হয়তো ভেবেছিলেন, ওর সঙ্গে একটা সমঝোতায় এসে ওকে দিয়ে কেস করাবেন আরও বেশি টাকার জন্যে-ফলে বাঁটোয়ারা পিছিয়ে যাবে আরও। মোট কথা, আপনার কাকার মৃত্যু পর্যন্ত যেমন করে হোক ঠেকিয়ে রাখতে হবে ভাগাভাগিটা। কিন্তু স্ট্যানলি হাসপাতাল থেকে গায়েব হয়ে যাওয়ায় চিন্তায় পড়ে গেলেন আপনি, ভাবলেন কবে না জানি হাজির হয়ে যায় ছোকরা টাকার জন্যে। আরও ভয়, কবে না জানি ও যোগাযোগ করে বসে অন্যান্য ভাগীদারদের সঙ্গে! কাজে কাজেই আমাদের সাহায্য আপনার দরকার হয়ে পড়ল।’