‘মা। ওহ্-হো! মাকে তো বলতেই ভুলে গেছি, আগামী কয়েকটা দিন থাকছি না এখানে।’
‘পরে ফোন করে জানিয়ে দিলেই হবে। একটা ব্যাগে তোমার জিনিসপত্র গুছিয়ে নাও, তবে এখুনি বেরিয়ে পোড়ো না, আমি ফোন করলে তারপর। ক্লিপটনের লেলিয়ে দেয়া ত্যাড়া এক প্রাইভেট আই একটু আগে এসেছিল এখানে, ব্যাটা কী করে জানি খুঁজে বের করে ফেলেছে আমাকে। তাই এই হোটেল ছেড়ে এখনই সরে যেতে হচ্ছে।’
‘তোমার খোঁজ বের করল কেমন করে ওরা? ইশ্শ্! এসবের মধ্যে না জড়ালেই আমরা ভাল করতাম। ভীষণ ভয় লাগছে আমার, ফিল! এত টেনশন হচ্ছে যে…’
‘মাথা ঠাণ্ডা রাখো, ডারলিং। কিচ্ছু ভেবো না তো! ভয় পাওয়ার মত কিছুই ঘটেনি এখন পর্যন্ত, ভবিষ্যতেও ঘটবে না। উত্তরাধিকারের ব্যাপারে আমার কোনও আগ্রহ নেই জানিয়ে দিয়ে আমি ভাগিয়ে দিয়েছি ব্যাটাকে। আরেকখানে সরে গিয়েই তোমাকে ফোন দেব। সাহস হারিয়ো না, নিজেকে শান্ত রাখো, লক্ষ্মী। বড়লোক হয়ে যাচ্ছি আমরা শীঘ্রি।’
এরপরের কলটা কতক্ষণ পর এল তা বোঝা গেল না, কারণ টেলিফোনের কথা শেষ হয়ে যেতেই টেপ রেকর্ডার বন্ধ ছিল। আবার সেই একই লোকের গলা শোনা গেল। বলছে, ‘সরে এসেছি, রিটা। ম্যানহাটনের ছোট, অখ্যাত, পুরোনো-তবে পরিষ্কার-পরিচ্ছনড়ব একটা হোটেলে; নাম মারলিন। দূর থেকেই একটা মাছের ছবি দেখতে পাবে। ডেস্কে বলে রাখব আমি, তুমি সোজা দোতলার একশ’ তিন নম্বর কামরায় চলে আসবে। এখানে কেউ খুঁজে পাবে না আমাদের। ব্যাগ গুছিয়ে তুমি তৈরি তো?’
‘হ্যাঁ।’
‘গুড! গাড়িটা গ্যারেজেই থাক, একটা ট্যাক্সি নিয়ে চলে এসো তুমি। এখন বাজে তিনটে। এখনই রওনা হলে পৌঁছে যাবে…’
গুলির শব্দে চমকে উঠল ওরা তিনজন। চাপা আওয়াজ-কিন্তু শব্দটা যে গুলির তাতে কোনও সন্দেহ নেই। পিস্তলের নলটা সম্ভবত লোকটার পিঠে ঠেকিয়ে টানা হয়েছে ট্রিগার।
‘উ-উ-হ!’
‘কী হলো! ফিল! ফিল! কীসের…’
খটাং শব্দে ক্রেডলে রাখল কেউ ফোনের রিসিভার। কেটে গেল কানেকশন। থেমে গেল টেপ।
প্র ম থেকে শেষ পর্যন্ত টেপটা আবার একবার শুনল রানা। ডুবে গেল গভীর চিন্তায়। ওকে চিন্তামগড়ব দেখে আলগোছে কামরা থেকে বেরিয়ে গেল গিলটি মিয়া তার সাগরেদকে নিয়ে। ঠিক দশটায় ফোন করে নিউ ইয়র্ক পুলিশের ক্যাপটেন জোসেফ ক্রাউলিকে সিটেই পেল রানা। বহুদিনের পরিচয়, রানার গলা পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠতে যাচ্ছিলেন ক্রাউলি; থমকে গেলেন ওর প্রশড়ব শুনে। জানতে চাইলেন, ‘কোন্ খুনটা মিস্টার রানা? মারলিন হোটেলের সেই রবার্ট স্ট্যানলি?’
‘হ্যাঁ। মৃত্যুর সঠিক সময়টা আমার জানা দরকার।’
‘ঠিক আছে, জেনে নিয়ে জানাচ্ছি। আপনি অফিসে না বাসায়?’
‘অফিসে।’
‘ঠিক আছে, জানাচ্ছি… ভাল কথা, এই কেসে কার ব্যাপারে আপনি ইণ্টারেস্টেড?’
‘প্র মত, রিটা শেফার্সের ব্যাপারে।’
‘খুনি মেয়েটাকে ডিফেণ্ড করবেন নাকি?’
‘চেষ্টা করব।’
‘কী বললেন? আপনি একটা খুনির হয়ে…’
‘খুনটা ও করেনি, ক্যাপটেন,’ শান্ত কণ্ঠে বলল রানা।
‘অ্যাঁ?’ মনে হলো খাবি খেলেন ক্যাপটেন ক্রাউলি। ‘বলেন কী, মিস্টার রানা? হাতে-নাতে ধরা হয়েছে ওকে! আপনি প্রমাণ করতে পারবেন যে, কাজটা ওর নয়?’
‘পারব। তবে প্রমাণটা নিশ্ছিদ্র করতে হলে আপনার সাহায্য লাগবে। মেয়েটি নিরপরাধ।’
থমকে গেলেন অফিসার। চুপ করে থাকলেন কিছুক্ষণ। রানার মন্তব্য ঘাবড়ে দিয়েছে তাঁকে। তা হলে কি ভুল মানুষকে ধরে এনেছেন?
‘সত্যিই যদি নিরপরাধ হয়,’ বললেন ক্যাপটেন, ‘একশোবার সাহায্য করব আমি। আর আসল খুনি যদি ধরা পড়ে, তা হলে তো সোনায় সোহাগা! আমি কি চলে আসব আপনার অফিসে?’ ‘আমিই আসছি আপনার কাছে। ইতিমধ্যে মৃত্যুর সঠিক সময়, আর আজ বিকেলে ওই হোটেলে ঠিক কী কী ঘটেছে জেনে নিয়ে তৈরি হয়ে থাকুন। বলা যায় না, আসল খুনি ধরা পড়তেও পারে! ইন দ্যাট কেস, দ্য হোল ক্রেডিট গোজ টু ইউ। ঠিক আছে?’
‘হানড্রেড পার্সেণ্ট!’ বললেন উল্লসিত ক্যাপটেন। ‘তা হলে চলে আসুন। রাখলাম।’
৫
রাত দুটো দশে ফোন করল রানা লইয়ার অ্যাডাম ক্লিপটনের বাড়ির নম্বরে। রানার গলা শুনেই মহা খাপ্পা হয়ে উঠল আইনজীবী, ‘মিস্টার মাসুদ রানা, রাত কয়টা বাজে এখন-আপনার কি সময়জ্ঞান বলতে…’
‘দুটো বেজে এগারো,’ বলল রানা। ‘আপনার সঙ্গে এখনই একবার দেখা হওয়া দরকার আমার। আশাকরি রবার্ট স্ট্যানলির মৃত্যুর খবরটা জানা আছে আপনার?’
‘পুলিশ জানিয়েছে আমাকে। ওর লাশের পকেটে আমার লেখা চিঠি পাওয়া গেছিল। কিন্তু, রানা, এই রাতে আপনি…’
‘ক্লিপটন, আধঘণ্টা পর আপনাকে বাড়ির সামনে থেকে তুলে নেব আমি। তৈরি থাকবেন!’ বলেই লাইন কেটে দিল রানা।
ঠিক আধঘণ্টা পর গেটের সামনে এসে দাঁড়াল রানার গাড়ি। বড়সড় একটা লনের ওপাশে আঁধার হয়ে আছে উকিলের বাড়িটা। গেটের পাশে একটা পিলারের গায়ে হেলান দিয়ে অপেক্ষা করছিল ক্লিপটন, রানা থামতেই লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এল। মাথায় বড়সড় একটা টুপি পরেছে, গায়ে গাঢ় রঙের দামি সুট, হাতে নরম পিগস্কিনের পাতলা গ্লাভস। টুপি আর গ্লাভস দেখে কিছুটা স্বস্তি বোধ করল রানা। পাশের সিটে উঠে বসতে বসতে জিজ্ঞেস করল লইয়ার, ‘আমার সঙ্গে যে দেখা করতে আসছেন একথা আর কে কে জানে, রানা?’