‘নাহ্, কাউকে দেখিনি। মনে হলো মেয়েটা কারও অপেক্ষায় আছে, খুব দুশ্চিন্তায়। এবার, ওস্তাদ?’
‘এবার একটু ঘুরে-ফিরে এসো বাইরে থেকে। আদঘণ্টা পর পাবলিক ফোনবুত থেকে কতা বলবে তুমি মেয়েটার সাতে।’ কী কথা বলতে হবে ক্যাভিনকে শিখিয়ে দিল গিলটি মিয়া।
আধঘণ্টা পর শেফার্সদের নম্বরে রিং দিল ক্যাভিন। মেয়েটি রিসিভার তুলে হ্যালো বলতেই গলাটা ভারী করে বলল, ‘মিসেস শেফার্স, আমি রবার্ট স্ট্যানলির একজন শুভাকাঙক্ষী, বন্ধু। আপনি কি…’
‘রং নাম্বারে কল করেছেন!’ বলেই খটাং করে নামিয়ে রাখল মেয়েটি রিসিভার।
আবার ডায়াল করল ক্যাভিন। পাঁচ-ছয়বার বাজার পর রিসিভার তুলল মেয়েটি, ‘ইয়েস?’
‘মিসেস শেফার্স, আমি কী বলি না শুনেই রিসিভার নামিয়ে রাখবেন না। আমি জানি, প্লেনক্রাশের পর আপনি রবার্ট স্ট্যানলিকে হাসপাতাল থেকে নিয়ে এসেছেন। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া বড় অঙ্কের টাকা ওঁর হাতে তুলে দিতে চাই। আপনি যদি…’
‘আমি একবার আপনাকে বলেছি: ভুল নাম্বারে ডায়াল করেছেন আপনি! রবার্ট কী যেন বললেন, ওই নামের কাউকে চিনি না আমি। দয়া করে আমাকে আর বিরক্ত করবেন না!’ বলেই আবার আছড়ে রাখল মহিলা রিসিভার।
ক্যাভিনের মনে হলো, হিস্টিরিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পাচ্ছে মেয়েটির আচরণে। ফিরে গিয়ে রিপোর্ট করবার প্রয়োজন হলো না, ওয়ায়্যারলেস রিসিভারের কল্যাণে সবই শুনেছে গিলটি মিয়া। বরং সে-ই শোনাল নতুন খবর।
‘তোমার দুইলম্বর কল পাওয়ার আদ মিলিটের মদ্যেই পোটল্যান হোটেলের ২৩২ লম্বর কামরায় মিশটার ব্রেনান বলে একজনের সাতে কতা বলেচে মেয়েটা। বোধায় ওই নামেই ওখেনে উটেছে ইস্ট্যানলি। থত্থর করে কাঁপচে গলা, তোমার সাতে কী কতা হলো সব জানাল মেয়েটা ওকে। নিজ কানে শুনে দ্যাকো।’
রেকর্ডার রিওয়াইণ্ড করে চালিয়ে দিল গিলটি মিয়া।
‘শান্ত হও, রিটা। একটুও ঘাবড়িয়ো না তুমি। সব ঠিক হয়ে যাবে। লোকটা আবার যদি ফোন করে, তুমি সাফ বলে দেবে ওর একটা কথাও বুঝতে পারছ না। আচ্ছা, রিটা, কয়েকটা দিন তোমার মায়ের কাছে গিয়ে থাকো না। ঝামেলা সামলে নিয়েই আমি ডেকে পাঠাব তোমাকে।’
‘ওখানে গিয়ে নাটক করতে পারব না আমি। অসম্ভব। এমনিতেই ভয়ে গলা শুকিয়ে আসছে আমার। বিশ্বাস করো, দুশ্চিন্তায় মরে যাচ্ছি… স্রেফ পাগল হবার দশা!’
‘শান্ত থাকার চেষ্টা করো, হানি। এক কাজ করো, টেলিফোন এলে ধোরো না। কিংবা… তার চেয়ে ভাল হয়, চলে এসো আমার এখানে।’
‘কিন্তু মা যদি ফোন করে দেখে কেউ ধরছে না, তা হলে কী তুলকালাম কাণ্ড বাধাবে কে জানে! হয়তো… উফ্! মনে হচ্ছে ভেঙে চৌচির হয়ে যাচ্ছি আমি!’
‘রিটা, মাথা ঠাণ্ডা রাখো, লক্ষ্মীটি। এখন পর্যন্ত সবই ঠিকঠাক মত চলছে। আমার কথা শোনো: তোমার ঘনিষ্ঠজনদের ফোন করে জানিয়ে দাও, দিন কয়েকের জন্যে অন্য কোথাও যাচ্ছ তুমি, বলবে: এ-বাড়িতে একা থাকতে গা ছমছম করছে তোমার, চমকে চমকে উঠছ, এইসব আরকী। তারপর চলে এসো আমার কাছে। দুপুর দুটোর মধ্যে পৌঁছে যাবার চেষ্টা কোরো। কোনও ভয় নেই, কোনও বিপদ হবে না-নিজেকে শান্ত রাখতে পারলে দেখবে কয়েকদিনেই স্বাভাবিক হয়ে গেছে সব। তা হলে রাখি এখন… দেখা হচ্ছে দুটোয়, ছাড়লাম।’
‘বাহ্! একেবারে পরিষ্কার রেকর্ডিং!’ হাসল ক্যাভিন। ‘এখন আমরা কী করব, ওস্তাদ?’
‘সেইটে জানতেই একবার আপিসে যেতে হবে আমাদের,’ বলল গিলটি মিয়া। ‘রেকর্ডারটা অটোতে সেট করাই আচে। এই ক্যাসেট খুলে আরাকটা ফিট করে দিচ্চি, তুমি গাড়িটা লিয়ে গিয়ে ও-বাড়ির কাচাকাচি পার্ক করে ইঞ্জিলের বনেট খুলে এটা- ওটা ঘাঁটো, তারপর দরজা-জানলা লক করে চলে এসো আমার কাচে। আমরা প্রত্থমে উ-ই ওষুদের দোকানে যাব, তারপর আপিসে।’
ওষুধের দোকানে ফোনবুক ঘেঁটে জানা গেল, পোর্টল্যাণ্ড হোটেলটা ব্রুকলিনে।
একটা ট্যাক্সি নিয়ে ফিরে এল ওরা অফিসে। দেখল, দুই পা টেবিলের উপর তুলে দিয়ে এক হাতে কফির কাপ, অপর হাতে একটা ফাইল ধরে রেখে জানালা দিয়ে বাইরে চেয়ে রয়েছে মাসুদ রানা। ওদের দেখে সোজা হয়ে বসল।
চুপচাপ শুনল রানা আদ্যোপান্ত সব। দু’বার বাজিয়ে শুনল টেলিফোনের আলাপ।
‘এবার?’ জিজ্ঞেস করল ও, ‘এবার কী করবে ভাবছ?’
‘অ্যাকোন ওই আদম ব্যাপারী, থুড়ি, আদম কিলিপটন সায়েবকে ঠিকানাটা জানিয়ে দিলেই আমাদের কাজ শেষ।’ মাথা নাড়ল রানা।
‘তার আগে জানতে হবে এই লোক সত্যিই রবার্ট স্ট্যানলি কি না। আর যদি স্ট্যানলিই হয়, পালিয়ে বেড়াচ্ছে কেন, কীসের ভয়ে। রিটা শেফার্সের সঙ্গেই বা তার কী সম্পর্ক। তা-ই না?’
‘ঠিক বলেচেন, সার!’ একযোগে মাথা ঝাঁকাল ক্যাভিন ও গিলটি মিয়া।
রানা বলল, ‘চলো, আমিও যাচ্ছি তোমাদের সঙ্গে।’
৩
মাঝারি মানের হোটেল, তবে নতুন। ছোকরা ঘাবড়ে যেতে পারে ভেবে গিলটি মিয়া আর ক্যাভিন হাওয়ার্ডকে নীচের ফয়ে- তে অপেক্ষা করতে বলে উঠে এসেছে রানা তেতলায়। টোকা দিতেই খুলে গেল ২৩২ নম্বর কামরার দরজা। জিন্সের প্যাণ্ট আর হালকা নীল, বুক-খোলা শার্ট পরা লম্বা এক লোককে দেখা গেল দরজার ওপাশে। চেহারা হুবহু মিলে যায় নার্সদের বর্ণনার সঙ্গে। অপরিচিত লোক দেখে কুঁচকে গেল ভুরু। বলল, ‘সিধে রাস্তা মাপো, মিস্টার। কিছু কেনার মুডে নেই আমি এখন।’ কথাগুলোর সঙ্গে ভেসে এল সস্তা হুইস্কির গন্ধ। দরজাটা বন্ধ করে দেবার আগেই জুতো পরা পা ঢুকিয়ে দিল রানা কপাটের ফাঁকে, তারপর বের করে দেখাল রানা এজেন্সির ইনভেস্টিগেশন লাইসেন্স।