‘বেশ। ওর খোঁজ পেলেই আমাকে জানাবেন।’ উঠে দাঁড়িয়ে পকেট থেকে মোটাসোটা একটা ওয়ালেট বের করে নিজের ভিজিটিং কার্ড আর দু’দিনের ফি গুনে দিল লোকটা ক্যাভিনের হাতে। সঙ্গে সঙ্গে একটা রসিদ লিখে দিল ক্যাভিন। রসিদ নিয়ে ঘুরে দাঁড়াবার আগে নীল চোখের দৃষ্টি রাখল লোকটা গিলটি মিয়ার উপর। ‘কাজটায় গোপনীয়তা বজায় রাখলে খুশি হব।’ ‘কী বললেন?’ জিজ্ঞেস করেই নিজেকে সামলে নিল গিলটি মিয়া। ‘ঠিক আচে, তাই হবে।’
অ্যাডাম ক্লিপটন বেরিয়ে যেতেই রানার কামরায় এসে ঢুকল গিলটি মিয়া। দেড়মাস পর রানাকে দু’দিনের জন্য একা পেয়েছিল, মোটকু লোকটা এসে বাজে একটা কাজ চাপিয়ে দিয়ে সব ভজকট করে দিয়ে গেল বলে বিরক্ত।
‘কী বুজলেন, সার? বাজে সোমায় নষ্ট না?’
‘কীভাবে এগোবে ভাবছ?’ পাল্টা প্রশড়ব করল রানা।
‘সেই তো থোড়-বড়ি-খাড়া আর খাড়া-বড়ি-থোড়! হাঁসপাতাল থেকে শুরু কত্তে হবে একোন। জানা দরকার ছোকরা ওখেন থেকে পালাই-পালাই করল কেন, গেলই বা কার সাতে, কোতায়। সাঁজ তো হয়ে এল, ভাবচি, এখুনি একবার গিয়ে খোঁজ লিয়ে আসি।’
‘চলো, আমিও যাব তোমার সঙ্গে,’ সামনের ফাইলটা বন্ধ করে আউট ট্রে-তে নামিয়ে রেখে বলল রানা। ‘তার আগে, দাঁড়াও দু’টো টেলিফোন সেরে নিই।’
একটা ক্রেডিট রেটিং হাউসে ফোন করে এক বন্ধুকে দুটো নাম দিয়ে তাদের রেটিং জানাবার অনুরোধ করল রানা। প্র ম নামটা নিউ ইয়র্কের অ্যাডাম ক্লিপটন, দ্বিতীয়টা নিস-এর রবার্ট স্ট্যানলি। এরপর নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক পরিচিত সাংবাদিকের কাছ থেকে জেনে নিল প্লেন ক্রাশের সঠিক সময়টা।
ব্রুক হাসপাতালের ইমার্জেন্সি ডিউটি অফিসারকে রানা এজেন্সির লাইসেন্স দেখিয়ে ওদের আগমনের উদ্দেশ্য জানাল রানা। বলল: রবার্ট স্ট্যানলিকে দরকার তার উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্য ত্রিশ হাজার ডলার বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে লোকটা কোথায় যে হাওয়া হয়ে গেল, খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। দুর্ঘটনার দিন যেসব ডাক্তার-নার্স ডিউটিতে ছিলেন তাঁদের সঙ্গে কথা বলা গেলে হয়তো কিছু সূত্র পাওয়া যেত। সব শুনে ভদ্রলোক ইণ্টারকমের মাধ্যমে ব্যবস্থা করে ওদের সঙ্গে একজন ওয়ার্ড-বয়কে দিলেন ঠিক জায়গায় পৌঁছে দেয়ার জন্য।
নার্স দুজনের কাছ থেকে রবার্ট স্ট্যানলির চেহারার একই বর্ণনা পাওয়া গেল: লম্বা, স্পোর্টসম্যানের মত একহারা গড়ন, ওজন পঁচাত্তর কেজির মত, কালো চুল, সাদামাটা চেহারা। আন্দাজ, ত্রিশের মত হবে বয়স। কোটের বেশ কিছু অংশ পুড়ে গিয়েছিল। ডাক্তার বললেন, ‘রবার্ট স্ট্যানলির শরীরে কোথাও কোনও আঘাত বা জখমের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কেবল কিছুটা নার্ভাস দেখাচ্ছিল। বলল: ব্যথা অনুভব করছে না, সেডেটিভের কোনও প্রয়োজন নেই। ঘণ্টাখানেক পর একটু সুস্থির হয়ে বাইরে কোথায় যেন ফোন করল। বিশ মিনিটের মধ্যেই বছর পঁচিশেকের সুন্দরী এক মহিলা এসে দেখা করল ওর সাথে। তারপর ডাক্তারদের কারও বারণ না মেনে চলে গেল ও মেয়েটির সঙ্গে-কোথায়, কে জানে!’
‘বেডে শুয়েই ফোন করেছিল?’ জানতে চাইল রানা। ‘হ্যাঁ।’
‘গুড। তা হলে তো নিশ্চয়ই কোথায় ফোন করেছিল তার রেকর্ড রয়েছে সুইচবোর্ডে। নম্বরটা আমাকে দেওয়া যাবে?’ ‘নিশ্চয়ই।’
নম্বরটা নিয়ে ফিরে এল ওরা এজেন্সির অফিসে। গিলটি মিয়া বলল, ‘কেবিনের এক বন্দু আচে, সার, টেলিফোন কোম্পানিতে।’
‘বেশ, ডাকো ওকে।’
ইনভেস্টিগেশনে ওর সাহায্য দরকার শুনে বত্রিশ পাটি দাঁত বেরিয়ে পড়ল ক্যাভিন হাওয়ার্ডের। তিন মিনিটের মধ্যে জানা গেল নম্বরটা ফিলিপ শেফার্স নামে এক লোকের, ঠিকানা: ১৪৪২/ডি, পিজিয়ন লেন, কুইন্সভিল রেসিডেনশিয়াল এরিয়া, নিউ ইয়র্ক।
রানা জানে, ওখানে নিমড়ব-মধ্যবিত্তদের বাস। রাস্তার দু’পাশে ছোট ছোট অনেকগুলো একতলা বাড়ি আছে ওখানে লাইন দিয়ে।
‘চলো, বাড়িটা চিনে আসা যাক,’ বলল রানা। ক্যাভিনের দিকে চেয়ে হাসল, ‘তুমিও চলো।’
উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল ছোকরা। চোখদুটো জ্বলছে সন্ধ্যাতারার মত। সোজা কথা? রানা এজেন্সির চিফের সঙ্গে চলেছে সে একটা কেসের সমাধানে, তাঁকে সাহায্য করতে! বাপরে, বাপ!
নম্বর মিলিয়ে চিনতে অসুবিধে হলো না। বাড়িটার সামনে ছোট্ট লন। দরজা বন্ধ। ধীর গতিতে গাড়ি চালিয়ে পুরো এলাকাটা একবার ঘুরে দেখে চলে এল ওরা অফিসের কাছাকাছি এক রেস্তোরাঁয়। এখানে ভাল বাংলাদেশী রানড়বা পাওয়া যায়। খাওয়ার পর গিলটি মিয়া ও তার সাকরেদকে বিদায় দিয়ে সেঁটে একটা ঘুম দেবে বলে চলে গেল রানা নিজের অ্যাপার্টমেন্টে। ঠিক হলো, আগামীকাল সকাল থেকে শুরু হবে ওদের কাজ। দায়িত্বে থাকবে গিলটি মিয়া, সহকারী ক্যাভিন হাওয়ার্ড। দুই দিনের মধ্যে খুঁজে বের করতে হবে স্ট্যানলিকে। কাজটার শেষ দেখেই রানা চলে যাবে লস অ্যাঞ্জেলেস শাখা পরিদর্শনে।
পরদিন সকাল দশটায় ফোন করল রানা ক্রেডিট অফিসে। এরা এফবিআই-এর চেয়েও ভাল রেকর্ড রাখে। বন্ধু জানালো, ‘রবার্ট স্ট্যানলির উপর কোনও রেকর্ড নেই; তার মানে লোকটা বাউণ্ডুলে, বাঁধা কোনও চাকরি বা কাজ নেই-অর্থাৎ, ক্রেডিট রিস্ক। তবে ওই অ্যাডাম ক্লিপটনকে ধার দিলেও ঠকবি। একটা অ্যাপ্লায়ান্স স্টকে বড় দান মারতে গিয়ে আচ্ছা ধোলাই খেয়েছে লোকটা বছরখানেক আগে। আইন ব্যবসায় ওর রোজগার বছরে বড়জোর বিশ হাজার ডলার, কিন্তু খরচ করে তার দ্বিগুণেরও বেশি-বাড়ি রয়েছে শহরতলির ধনী এলাকায়, দুটো গাড়ি এবং একটা খরুচে বউ পোষে, গোটা দুই অভিজাত ক্লাবের মেম্বার। দেনায় গলা পর্যন্ত ডুবে আছে লোকটা। মাস কয়েক আগে শেয়ার মার্কেটে বেশ ভাল একটা দান মেরে কিছু কিছু ঋণ শোধ করেছে। কিন্তু এখনও প্রচুর দেনা। ধনী পরিবারে জন্ম। নিঃসন্তান এক কাকা মারা গেলে উত্তরাধিকার সূত্রে অনেক টাকার মালিক হবে। কিন্তু কাকাটা কিছুতেই মরছে না, ঊনআশি বছর বয়সেও পাল্লা দিয়ে নিয়মিত টেনিস খেলে চলেছে ছেলে- ছোকরাদের সাথে। ভাতিজার চেয়ে অনেক ফিট। বুঝলি এখন?’