‘রানা, মিথ্যে ভ্যাজর-ভ্যাজর করছ!’ সম্বোধনটা তুমিতে নেমে আসায় মনে মনে খুশি হলো রানা। ক্লিপটনের কঠোর মুখ ঘামে চকচক করছে। ‘তোমাকে আমি নিখোঁজ এক লোককে খুঁজে বের করবার কাজ দিয়েছিলাম, তুমি সে কাজ করেছ-এর মধ্যে কোনও অন্যায় বা ঘোরপ্যাঁচ নেই। লোকটা যদি পরবর্তী সময়ে খুন হয়ে যায়, সে-দায় কিছুতেই আমার ওপর বর্তায় না!’
রানা ভাবছে, এখনও পিস্তল বের করছে না কেন লোকটা! বলল, ‘এই মৃত্যু বণ্টনের কাজটা দেরি করিয়ে দেবে না বলতে চান? যেটুকু সময় পাওয়া যাবে তার মধ্যে যদি আপনার কাকা মারা না যায়, তাকে মারাও তো আপনার জন্যে কঠিন কোনও কাজ নয়। কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করছেন, যেন আপনার কাকা মারা যায়, কিন্তু আসল কথাটাই তো আপনার জানা নেই-ওই লোকটা রবার্ট স্ট্যানলি ছিল না।’
বজ্রপাতের পরমুহূর্তের স্তব্ধতা। আত্মা চমকে গেছে অ্যাডাম ক্লিপটনের।
‘তোমার এই গাঁজাখুরি গপ্পো শোনার ধৈর্য আর আমার নেই, রানা। আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে…’
‘প্লেন ক্র্যাশেই মারা গিয়েছিল আসলে রবার্ট স্ট্যানলি।’ কয়েক সেকেণ্ড চুপ করে থাকল রানা। ‘ফিলিপ শেফার্সও ছিল একই প্লেনে-বেঁচে যাওয়াদের একজন। স্ট্যানলি মনে করে আপনি এই ফিলিপ শেফার্সকে খুন করেছেন, ক্লিপটন। দুর্ঘটনায় একটুও জখম হয়নি শেফার্স, বরং ঝাঁকি খেয়ে বুদ্ধি খুলে গিয়েছিল ওর। ইনশিওরেন্সের মোটা টাকার জন্যে মাথায় খেলে গিয়েছিল পরিচয় বদলের আইডিয়াটা। স্ট্যানলির জ্বলন্ত মৃতদেহের পাশে পড়ে থাকা ওয়ালেটটা কুড়িয়ে নিয়ে নিজের লাইটার ছুঁড়ে দিয়েছিল ওর লাশের গায়ে। স্ট্যানলি হিসেবে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার একঘণ্টার মধ্যে ফোন পেয়ে ওর স্ত্রী রিটা শেফার্স এসে ওকে নিয়ে যায়। ফিলিপ শেফার্সের মতলবটা বোঝা কঠিন কিছু নয়: ইনশিওরেন্সের টাকা ছাড়াও ওর বউ ট্রান্স-আটলাণ্টিক এয়ারলাইন্স থেকে বড় অঙ্কের ক্ষতিপূরণ তুলবে, তারপর দুজন মিলে দেশান্তরি হবে। আগুনে পুড়ে ভস্ম হয়ে যাওয়ায় কোন্টা কার লাশ চেনার কোনও উপায় ছিল না। সেই অনিশ্চয়তার সুযোগ নিয়েই…’
‘এটা তোমার আরেক ধাপ্পাবাজি!’ বলে উঠল ক্লিপটন। ওর চোখ দুটোকে নীল মার্বেলের মত লাগছে এখন দেখতে। সাপের মত ঠাণ্ডা দৃষ্টি সে-চোখে।
‘আপনার ওই তিরিশ হাজার ডলারের লোভ যে ফিলিপকে বেশ কিছুটা দুলিয়েছে, তাতে কোনও সন্দেহ নেই। স্ট্যানলির ওয়ালেটে আপনার চিঠি পেয়ে ওই টাকার ব্যাপারে জেনেছিল সে। কিন্তু সামনে আসতে ভয় পেয়েছে বেচারা, ভেবেছে, হয়তো আপনার বা স্ট্যানলির পরিবারের কারও কাছে ধরা পড়ে যাবে যে ও আসল লোক নয়। ও তো জানত না, আপনি বা স্ট্যানলির ভাগীদারদের কারও জানা নেই ও দেখতে কেমন। ডিয়ার অ্যাডাম ক্লিপটন, আর সব অ্যামেচারদের মতই নিরেট গাধামি করেছেন আপনি। মিসেস শেফার্স ছাড়া একমাত্র আপনিই জানতেন কোথায় লুকিয়ে আছে স্ট্যানলি, ওরফে ফিলিপ শেফার্স। গতকাল দুপুরে আপনাকে যখন আমি টেলিফোনে জানালাম, পোর্টল্যাণ্ড হোটেলের ২৩২ নম্বর কামরায় পল ব্রেনান নাম নিয়ে আছে রবার্ট স্ট্যানলি, ছুটলেন আপনি সেখানে। কিন্তু পৌঁছেই জানতে পারলেন, হোটেল ছেড়ে চলে যাচ্ছে স্ট্যানলি। ওর পিছু নিয়ে আপনিও চলে গেলেন ম্যানহাটনের মারলিন হোটেলে। তারপর আড়াল থেকে যখন শুনলেন রিটা শেফার্স নামে একটা মেয়েকে ডাকছে স্ট্যানলি ওই হোটেলে, তখনই মাথায় ঝিলিক দিল শয়তানি বুদ্ধি। ওর পিঠে পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করলেন আপনি, তারপর ঘাপটি মেরে অপেক্ষা করলেন রিটার জন্যে।’
দরদর করে ঘামছে এখন অ্যাডাম ক্লিপটন। মাথা থেকে টুপিটা সরাল। বোঝা গেল, ওখানেই ছিল ওর দুই শটের ডেরিঞ্জার পিস্তলটা। রানার বুক বরাবর তাক করে ধরল সে ওটা। ‘তোমার এই বেপরোয়া দুঃসাহসের প্রশংসা করতে পারছি না, মাসুদ রানা। গাধামি আমি নই, তুমিই করেছ এই নির্জন জায়গায় আমাকে নিয়ে এসে। কষ্ট করে সত্যটা আবিষ্কার করেছ বটে, কিন্তু তাতে লাভ হলো না কিছুই। বুঝতেই পারছ, এত কথা বলে নিজের মৃত্যু নিজেই ডেকে এনেছ তুমি। বাধ্য হয়েই তোমাকে এখন খুন করতে হচ্ছে আমার!’
‘আরে, করেন কী, করেন কী!’ আর্তনাদ করে উঠল রানা। ‘দেখুন, স্টিয়ারিং ধরে আছি আমি দুই হাতে। ভয় পেয়ে তাড়াহুড়োয় কিছু না করে আমার কথাটা শেষ করতে দিন। তার আগে গ্লাভ কম্পার্টমেণ্টটা খুলে ট্র্যান্সমিটারটা একনজর দেখে নিন। এতক্ষণ আমাদের যা কথা হয়েছে সব শুনেছেন ক্যাপটেন জোসেফ ক্রাউলি, সেইসাথে সবকিছু রেকর্ডও হয়ে গেছে পুলিশের টেপ রেকর্ডারে। আমাদের সব কথা ব্রডকাস্ট করেছি আমি, ক্লিপটন! খুলেই দেখুন সামনের গ্লাভ কম্পার্টমেণ্টটা।’
ঠাণ্ডা, নীল দৃষ্টি রানার চোখের উপর স্থির রেখে কম্পার্টমেণ্টটা খুলল ক্লিপটন, দস্তানা পরা বামহাত বাড়িয়ে বের করে আনল ট্র্যান্সমিটারটা। ধারা বিবরণীর মত বলে চলেছে রানা, ‘খুবই শক্তিশালী জিনিস, রেঞ্জ দু’হাজার গজেরও বেশি, পুলিশের…’
‘এসব চালবাজি তোমাকে রক্ষা করতে পারবে না, রানা। এটা ট্র্যান্সমিটার না কচু! ট্র্যান্সমিটার আমি চিনি না মনে করেছ? এর অ্যাণ্টেনা কোথায়? টিউব কোথায়? মাইক্রোফোন কোথায়? ধোঁকা দেয়ার…’