কিন্তু এ কেমন হলো? শত্রুপক্ষের একটা মেয়েকে ওর এত ভাল লাগল। কেন? কী এর পরিণাম? মনটা কিছুতেই আজ শাসন মানতে চাইছে না কেন?
কী ভাবছ?’ জিজ্ঞেস করল সুলতা।
কিছু না।’
‘কিছু না?
ভাবছি, আমি সুখী।
দূর থেকে একটা জাহাজের ভেঁপু বেজে উঠে ধ্বনি-প্রতিধ্বনি তুলল এ-বাড়ি ও-বাড়িতে ধাক্কা খেয়ে। আওয়াজটা শুনলে উদাস হয়ে যায় মন।
‘সারাদিন অনেক ধকল গেছে-চলো শুয়ে পড়বে। আমি তোমাকে ঘুম পাড়িয়ে দেব মাথায় হাত বুলিয়ে। রানার হাত ধরে টানল সুলতা।
অনেক গল্প হলো। কথায় কথায় রানা বুঝতে পারল কলকাতা অফিস থেকে। কতগুলো শব্দই কেবল মুখস্থ করিয়ে দেয়া হয়েছে সুলতাকে। ডিনামাইটগুলো। কোথায় ফাটানো হবে সে সম্বন্ধে কোনও ধারণাই নেই ওর। কী ঘটতে চলেছে সে। সম্পর্কে ওকে কোনও আভাস দেয়া হয়নি।
‘ঘুমিয়েছ? রানাকে কিছুক্ষণ চুপচাপ দেখে জিজ্ঞেস করল সুলতা।
না। তুমি শুয়ে পড়ো গিয়ে!’
‘যেতে ইচ্ছে করছে না।
চুপ করে থাকল রানা। কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে বলল, সুলতা, ‘তোমাকে এত ভাল লাগছে কেন বলো তো? আর কখনও তো কাউকে এমন লাগেনি! সত্যি!
বুকের আঁচলটা খসে পড়ল বিছানার উপর। রানা টেনে নিল ওকে। নিজের পা দুটো আলতো করে তুলে নিল সুলতা বিছানার উপর। টিশ টিশ শব্দে খুলে গেল কয়েকটা টিপবোতাম। চুমোয় চুমোয় পাগল করে তুলল রানা ওকে। ].
পরম নিশ্চিন্তে রানার বাম বাহুর উপর মাথা রেখে গভীর ঘুমে অচেতন সুলতা রায়। আস্তে করে মাথাটা তুলে বালিশের উপর রেখে, কপালের উপর থেকে এলোমেলো এক গোছা চুল সরিয়ে দিল রানা। তারপর উঠে গিয়ে সুটকেস থেকে স্কচ উইস্কির বোতলটা বের করে রাখল টেবিলের উপর। সারা রাত জাগতে হবে। যে-কোনও মুহূর্তে যে-কোনও দিক থেকে আক্রমণ আসতে পারে। কাপড়ের ভাজে সযত্নে রাখা সাইলেন্সারটা বের করে রাখল টেবিলের উপর। তারপর। ইজিচেয়ারে গিয়ে বসল।
ঘুমে আর ক্লান্তিতে ভেঙে আসতে চাইছে শরীরটা। একটা বেঞ্জেড্রিন ট্যাবলেট মুখে ফেলে এক ঢোক উইস্কি দিয়ে সেটা গিলে ফেলল রানা। জুলতে জ্বলতে নেমে গেল নীচে অ্যালকোহল, কোন রাস্তা দিয়ে গেল পরিষ্কার বুঝিয়ে দিয়ে। আরও কয়েক ঢোকের পর ধীরে ধীরে চাঙ্গা হয়ে উঠল শরীরটা। একটা সিগারেট ধরিয়ে এবার ইজিচেয়ারে গা এলিয়ে দিল রানা।
ঘুমন্ত সুলতার একটানা ভারী নিঃশ্বাসের শব্দ আর রিস্টওয়াচের একঘেয়ে টিকটিক করে বেজে যাওয়া। এক ফালি চাঁদের আলো এসে পড়েছে ঘরের ভিতর। অনেক কথা মনে এল রানার। অনেক টুকরো টুকরো ঘটনার স্মৃতি। জীবনের কত ছোট-খাটো সাধারণ কথা কোন্ ফাঁকে স্মৃতির পাতায় লেখা হয়ে গেছে। মণিমুক্তোর মত অমূল্য মনে হচ্ছে সেগুলোকে এখন। বড় বিচিত্র মানুষের মন। দূরে কোথাও ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজল তিনবার। রাত তিনটে।
ঘুমের ঘোরে সুলতাকে বিড় বিড় করে কিছু বলতে শুনে বিছানার পাশে এসে দাঁড়াল রানা। কিছুই বোঝা গেল না অস্পষ্ট এক আধটা অর্থহীন শব্দ ছাড়া। একটু হেসে টেবিলের কাছে ফিরে গিয়ে আধ গ্লাস উইস্কি দুই ঢোকে শেষ করল রানা, তারপর পশ্চিমের জানালাটার ধারে গিয়ে দাঁড়াল।
ডুবে যাচ্ছে চাঁদ। নিপ্রভ হলদেটে দেখাচ্ছে ওটাকে। সেই ম্লান আলোয় হঠাৎ রানার নজরে পড়ল, দু’জন লোক উঠে আসছে উপরে ছাঁদের ট্যাঙ্কে পানি তুলবার পাইপ বেয়ে।
মৃদু হাসল রানা। এবারের আক্রমণটা তা হলে এই পথে আসছে!
উপরের দিকে না চেয়ে নিশ্চিন্ত মনে সন্তর্পণে উঠে আসছে লোকগুলো। টেবিলের উপর থেকে সাইলেন্সরটা নিয়ে এসে ধীরে সুস্থে পেঁচিয়ে লাগাল রানা পিস্তলের মুখে। পাঁচ-ছয় হাত বাকি থাকতে প্রথম লোকটা দেখতে পেল রানাকে। কিন্তু বড়ো দেরি হয়ে গেছে তখন। টুথপেস্টের টিউব থেকে বুদ্বুদ বেরিয়ে যেমন শব্দ হয় তেমনি ‘ফট করে একটা শব্দ বেরোল রানার ওয়ালথার থেকে। পাইপ ছেড়ে নিঃশব্দে লোকটা তার সঙ্গীর উপর গিয়ে পড়ল। আচমকা আঘাতে সে-ও টাল সামলাতে পারল না। দু’জন একই সঙ্গে দ্রুত নেমে গেল নীচে। ঠিক চার সেকেণ্ড পর পশ্চিম দিকের আবর্জনাময় সরু সুইপার প্যাসেজে ভারী কিছু পতনের শব্দ হলো।
খালি বিছানাটায় শুয়ে পড়ল এবার রানা। বালিশের তলায় পিস্তল রেখে সেটার বাটের উপর ডান হাতটা রাখল ও অভ্যাস মত। তার পর ঘুমিয়ে পড়ল নিশ্চিন্ত মনে।
৬
কিন্তু অতখানি নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়া ঠিক হয়নি রানার। জেগে থাকলে পাঁচটা সাড়ে-পাঁচটার দিকে আস্তে খুট করে দরজার ছিটকিনি খোলার শব্দটা শুনতে ও পেতই। কবীর চৌধুরীকে ভয়ঙ্কর লোক হিসেবে ও চিনেছে, কিন্তু প্রয়োজনের সময় সে যে কতখানি দুর্দান্ত হয়ে উঠতে পারে সেটা ঠিক উপলব্ধি করতে পারেনি।
ঘুম ভাঙল রানার সকাল আটটায়। সুলতা অনেক আগেই ঘুম থেকে উঠে চান-টান করে আপন মনে সারা ঘরময় গুনগুন করে বেড়াচ্ছে। এটা ওটা গুছিয়ে রাখছে। চুপচাপ শুয়ে শুয়ে তাই দেখছিল রানা। হঠাৎ ওর দিকে চোখ পড়তেই লজ্জায় আরক্ত হয়ে উঠল সুলতার গাল। গত রাত্রির কথা মনে পড়ে যেতেই দুই হাতে চোখ ঢাকল সে।
একটু হেসে উঠে বসল রানা। সুটকেস থেকে টুথব্রাশ, টুথপেস্ট, সাবান আর কাপড় বের করে দিল সুলতা। আলতো করে ওর চিবুকটা একটু নেড়ে দিয়ে খুশি মনে শিস দিতে দিতে বাথরুমে গিয়ে ঢুকল রানা। বাথরুমের দরজায় ভিতর থেকে আর বল্টু লাগাল না।