দলপতি একবার রানার ইস্পাত-কঠিন চেহারার দিকে চাইল। বুঝল, খুন করতে এই লোক দ্বিধা করবে না। অপর দুজনকে বলল, ‘চাল বে, ভাগ ইয়াহসে!
তলপেটে লাথি খাওয়া লোকটা তার রিভলভার তুলে নেবার জন্যে এক পা এগোতেই রানা আবার বলল, ওটা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। যাও, সোজা। গাড়িতে ওঠো।’
আহত লোকটাকে দুজন হেঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গাড়িতে তুলল। তারপর ছেড়ে দিল গাড়ি। গলির সামনে দিয়ে যখন গাড়িটা বেরিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেই মুহূর্তে কী মনে করে হঠাৎ রানা একপাশের দেয়ালের গায়ে সেঁটে গেল। সঙ্গে সঙ্গে ঠিক নাকের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেল দুটো বুলেট।
পাঁচ-দশ গজ গিয়ে আবার থামল গাড়িটা। বোধকরি গুলি দুটো ঠিক জায়গা মত লাগল কি না দেখার জন্যে। রানার হাতের রিভলভারটা গর্জে উঠল এবার। একটা আর্ত চিৎকার শোনা গেল-এবং সঙ্গে সঙ্গেই একজস্ট পাইপের মুখ দিয়ে একরাশ ধোয়া ছেড়ে দ্রুত চলে গেল গাড়িটা ‘বিপণীবিতানের দিকে।
ফুটপাথের উপর পড়ে থাকা রিভলভারটা তুলে নিল রানা। দেখল দুটোই ওয়েবলি অ্যাণ্ড স্কটের অনুকরণে ফ্রন্টিয়ারের দাররাতে তৈরি থারটি-টু ক্যালিবারের রিভলভার। অনুকরণ এতই চমৎকার এবং নিখুঁত যে ধরাই যায় না যে এটা দেশি মাল। কিন্তু মহাপণ্ডিত পাঠান ছোট্ট একটা ভুল করে বসে আছে, তাই ধরা গেল। নামটা লিখতে দু’ একটা অক্ষর কখন যে এদিক ওদিক হয়ে গেছে, টের পায়নি। মৃদু হেসে প্যান্টের দুই পকেটে দুটোকে ভরে নিয়ে ধীর পদক্ষেপে উঠে এল রানা। দোতলায়।
ম্যানেজারের কাউন্টারে কেউ নেই। লাউঞ্জের দুটো টেবিল লম্বালম্বি ভাবে জড়ো করে হাসান আলী শুয়ে আছে, মাথার উপর একটা ফ্যান ফুল-স্পীডে ঘুরছে। একটু নাড়া দিতেই ধড়মড়িয়ে উঠে বসল হাসান আলী।
‘আমার কোনও টেলিগ্রাম এসেছে?’ জিজ্ঞেস করল রানা।
দুটো এসেছে, স্যর।
বালিশের তলা থেকে দুটো খাম বের করে দিল সে। রানা দেখল দুটোই আর্জেন্ট টেলিগ্রাম। একটা ওর নামে, আরেকটা সুলতার। খাম ছিঁড়ে দেখল রানা। প্রথমটায় লেখা:
সামথিং হ্যাঁপেণ্ড ইন কাপ্তাই স্টপ মিট আইইকো চিফ স্টপ ইনভেস্টিগেট অ্যাণ্ড রিপোর্ট।
আইটিসি
.
রানা ভাবল, কাপ্তাইয়ে আবার কী ঘটল? আগামী শুক্রবার অর্থাৎ পরশু তো। প্রেসিডেন্ট ওপেন করছেন প্রজেক্ট। সঙ্গে থাকবেন গভর্নর, ওয়াপদা চিফ, ইউএস এর রাষ্ট্রদূত, আরও কত হোমরা-চোমরা লোকজন। সেখানে আবার এমন কী ঘটে গেল যে তাকে এমন আর্জেন্ট টেলিগ্রাম করা দরকার হয়ে পড়ল?
দ্বিতীয় টেলিগ্রামে লেখা:
সেন সিক অ্যাট ঢাকা স্টপ নেগোসিয়েশন ব্রেক ডাউন স্টপ ক্লোজ ডিল উইথ নিউ কোম্পানি স্টপ ফর সলভেনসি রেফার টু চৌধুরী।
জেটিটি
দুটো টেলিগ্রামই পকেটে পুরে রানা বলল, ‘ঢাকায় একটা ফোন করা দরকার, হাসান আলী। ফোনের চাবিটা কি তোমার কাছে?
‘খুলে দিচ্ছি, স্যর,’ বলে হাসান আলী ম্যানেজারের কাউন্টারের উপর রাখা টেলিফোনটার তালা খুলে দিল। প্রথমে ৯১ ডায়াল করে ৮০০৮৩ ঘোরাল রানা। একবার রিং হবার সঙ্গে সঙ্গেই নারী কণ্ঠে শোনা গেল, ইন্টারন্যাশনাল ট্রেডিং করপোরেশন। মিস নেলী বলছি।’
‘আমি চিটাগাং থেকে সুবীর সেন বলছি, ডারলিং। এক্ষুণি রামকৃষ্ণের লাইন দাও, জলদি।
‘শাট আপ!’ নেলীর কৃত্রিম রাগত স্বর শোনা গেল। ঠিক দুই সেকেণ্ড পরেই রাহাত খানের ঠাণ্ডা গম্ভীর গলা পাওয়া গেল।
বল। খবর আছে কিছু?
‘আমার স্ত্রীর কাছে একটা টেলিগ্রাম এসেছে। তাতে দেখলাম ঢাকায় নাকি আমার এক বন্ধুর অসুখ…’
‘ওসব জানি। তোমার কী খবর?’ রানার কথায় বাধা দিলেন রাহাত খান।
‘শরীরটা বেশি ভাল যাচ্ছে না, স্যর।
‘খুব বেশি খারাপ? (রানা অনুভব করল রাহাত খানের কাঁচা-পাকা ভুরু জোড়া কুঁচকে গেছে।)
না, স্যর, তেমন কিছু নয়, এই সামান্য। এখানে হাসপাতালের খবরও বেশি ভাল না-জনা তিনেক মারা গেছে। আমাকেও ডাক্তাররা ছাড়তে চাইছিল না।
‘আচ্ছা!
আরও একটা খবর, এই একটু আগে আমার স্ত্রীকে বেড়াতে নিয়ে যাবার জন্যে এসেছিল ওর তিনজন মাসতুত ভাই। এত রাতে আর দিলাম না যেতে। ওদের দুজনের শরীরও বেশি ভাল দেখলাম না।’
কাণ্ডই বাধিয়ে বসেছ দেখছি।
উৎসবে অনেক বাজি পটকা ফুটেছে। আমার শ্বশুর বাড়িতে যদি একটা খবর দিয়ে দিতেন, স্যর, তা হলে আমি অনেক হয়রানি থেকে বাঁচতে পারতাম।’
বুঝলাম। আচ্ছা, আমি ফোন করে বলে দিচ্ছি। তা তোমার জন্মদিনে কী। উপহার পেলে অত বাক্স ভর্তি, বললে না?
‘একটা রেড়িয়ো ট্রানজিস্টার আর তিনটে বড় বড় ডিনার সেট।
বলো কী? ডিনার সেট দিয়ে কী করবে?
‘দেখি কী করা যায়, এখনও ঠিক বুঝে উঠতে পারিনি, স্যর।
‘তোমার বন্ধুদেরকে কবে নিমন্তন্ন করছ শ্বশুর বাড়িতে?’
‘আলাপ হয়েছে, তবে এখনও নেমন্তন্নের পর্যায়ে যায়নি। আমার পরিচয় পেয়ে অনেক খাতির যত্ন করল, ছাড়তেই চাচ্ছিল না।’
‘বেশ, যা ভাল বোঝ করো। শরীরের দিকে লক্ষ রাখবে-বিশেষ করে আজ রাতে। আর কিছু বলার আছে?’
না, স্যর।
‘বেশ, রাখলাম।
পাঁচতলায় উঠে এল রানা। ঘরের দরজায় ভিতর থেকে ছিটকিনি দেয়া। টোকা দিতেই কাছে এসে রানার গলা শুনে নিশ্চিন্ত হয়ে দরজা খুলল সুলতা। হাতে পয়েন্ট টু-ফাইভ ক্যালিবারের ছোট্ট একটা অ্যাস্ট্রা পিস্তল ধরা। বাঁটটা মাদার অভ পার্লের। উজ্জ্বল বাতির আলোয় একবার ঝিক করে উঠল।