পাঁচটায় ওর বাবা ওকে ডেকে ওঠালেন। চা খেয়ে নিয়ে গেলেন একটা লং ড্রাইভে। সন্ধ্যায় স্থানীয় একটা ছোট্ট ক্লাবে গান বাজনার আসরে উইলিয়াম গীটার বাজালো। ওর বাবা-মা সহ আমরা সবাই নাচলাম। সোফিয়াতেই মসি দু’য়েকের ভেতর এটা রপ্ত করে নিয়েছিলাম। ড্রিঙ্কস ওর বাবা কিনে সবাইকে দিলেন, স্যালী খেলো অরেঞ্জ জুস আর পটেটো চিপস্। দেখতে দেখতে সপ্তাহ কেটে গেল। একদিন দাওয়াত এলো তোমার বান্ধবী এ্যালিনের বাড়ি থেকে। আমি আগেই বলেছি আর তুমিও জানো এ্যালী সাংবাদিক। ডানাদের সঙ্গে ওদের কি যেন একটা আত্মীয়তা আছে, ও দেশের লোক ওটার হিসাব রাখে না, তবে সেই সূত্রে পারিবারিক সম্পর্ক এবং ঘনিষ্ঠতা বেশ নিবিড়।
এ্যালীর এ্যাপার্টমেন্ট কোপেনহেগেনে। ডানাই ওদের ছোট গাড়িটা চালিয়ে এলো। তখন সন্ধে সাতটা। আকাশে সূর্য মনে হয় মাঝখানে। একেবারে দুপুরের মতো আলো, ঐ পথের আলো বোধহয় আমার জীবনের আলোর রশ্মি দেখিয়েছিল। এ্যালীর এ্যাপার্টমেন্ট বেশ ছোটই। ঢুকতেই বসবার মতো ছোট্ট একটু জায়গা। খান চার পাঁচ গদী মোড়া চেয়ার। তারপর ঢুকতেই খাবার ঘর, মাঝারি টের্কিল, টেবিল ঘিরে দু’টা চেয়ার, একপাশে রান্নার ব্যবস্থা চুলা, ও-পাতিল রাখার জায়গা। বাঁ দিকে দরজা নেই কিন্তু পাতলা পর্দার ব্যবধান আছে এবং ওটাই বসবার জায়গা। দুতিনজন গল্প করছিলেন আমাদের দেখে হাতের গ্লাস নামিয়ে রাখলেন। এ্যালী আমার সঙ্গে ওদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। প্রথম ব্যক্তি হ্যাঁনসেন এ্যালীর স্বামী, দ্বিতীয় মহিলা ক্রিস্টিন আইজ্জীবী, তৃতীয় জন সাংবাদিক নিয়েলসেন। আমার হাতটা ওর হাতের ভেতর কি একটু কেঁপে উঠেছিল? নাকি ওটা বুকের কাঁপুনির প্রতিক্রিয়া।
বাড়ি ফিরলাম প্রায় রাত একটায়। আজ ঢাকার রাস্তার কথা ভাবি। রাত একটা দূরের কথা, গতবার তো দুপুর একটায় আমাদের চোখের সামনে মতিঝিলে এক ভদ্রলোককে ছুরি মেরে তাঁর ব্রিফকেস নিয়ে গেল। অবশ্য এতো ১৯৭৪ সালের কথা বলছি, ঢাকাও তখন এমনটি ছিল না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে ডানা বললো, তারা, তোমার ভালো লাগেনি না? আমি ওর কাঁধে একটা চাপ দিয়ে বললাম, এতো ভালো সন্ধ্যা আমি আমার জীবনে উপভোগ করি নি। ডানা উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো। বললো, আমাদের আরও অনেক ভালো বন্ধু আছে কিন্তু এখন সামারে সবাই বাইরে গেছে ছুটি ভোগ করতে। তবে ঐ যে আইনজীবী মহিলাকে দেখলে, উনি ঠিক আসবেন আমাদের বাড়িতে তোমার সঙ্গে দেখা করতে। উনি সমাজসেবামূলক আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত। বাংলাদেশ, তাদের মেয়েদের অবস্থা, এসব জানতে চাইবেন। আর আশা করি নিয়েল আসবে নিজের গরজে। কেন, নিজের গরজে কেন? হয়ত অলক্ষ্যে আমার মুখে কিছুটা লজ্জার ছাপ পড়েছিল। ডানা হেসে বললো এখন বুঝলে তো নিজের গরজ।
স্বপ্নের মতো কুড়িটা দিন কাটিয়ে এলাম যেন বাবা-মা-ভাই-বোনের সঙ্গে। একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম, যাদের তিন-চারটি সন্তান আছে তাদেরও পালক পুত্র আছে এবং বুঝবার উপায় নেই কে পালিত আর কে গর্ভজাত। এক মহিলা ডানার মাকে তাদের পালিত পুত্রের যে প্রশংসা করলেন আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আবার এক সকালে ওর বাবা আমাদের এয়ারপোর্টে পৌঁছে দিয়ে গেলেন, সঙ্গে ওর মা। নিয়ে এসেছিল, কথা ও বেশি বলে না। শুধু বলেছিল সোফিয়াতে দেখা হবে। শিগগির। ও ডানার গালে চুমু খেলো, আমার শুধু হাতটাই ধরেছিল। তাকিয়ে রইলাম আমি যতোদূর দৃষ্টি যায়। ঢাকা ছেড়ে আসবার দিন একবারও চোখে জল আসে নি। আজ যেন কিসের অভাবে আমার সমস্ত বুকজুড়ে সুখের অনুভূতি নামলো আমার দু’গাল বেয়ে। ডানার বাবা-মা জড়িয়ে ধরে চুমু দিলেন, আবার আসতে বললেন, এ তোমার নিজের বাড়ি যখন অসুবিধা হবে চলে এসো। হ্যাঁ, আজ ওবাড়ি আমার নিজের বাড়ি। এটাই ডেনমার্কে আমার বাপের বাড়ি আপা। আপনি তো দেখেছেন ওরা কেমন মানুষ। আর স্যালীর জন্য কেমন একটা মমতা অনুভব করি। স্যালী তো এখন পড়ছে। বড় হবে, উপার্জন করবে, বিয়ে করলে একটা পূর্ণ সুখী জীবন পাবে। আপা, আপনার মনে আছে এখান থেকে না গিয়ে নিয়ে এসেছিল এদের। বঙ্গবন্ধুর কতো সমালোচনা হয়েছে তখন। উনি নাকি বলেছিলেন কার ধর্ম কি হবে জানি না, তবে মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। সত্যিই তাই, স্যালী জানে ও ডেনিশ আর এখানকার জন্মানো একজন নাগরিকের সঙ্গে সব কিছুতে ওর সমান অধিকার।
১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে আপনি এসেছিলেন মেক্সিকো যাবার পথে। পদ্মিনী ও আপনারা আর কয়েকজন গেলেন, আমি তখন এখানে এসে গেছি। অর্থাৎ নিয়েল চেষ্টা করে কোপেনহেগেনের বড় একটা হাসপাতালে আমার চাকুরির ব্যবস্থা করে দিল। নার্সদের কোয়ার্টারে জায়গা পেলাম। উইকেন্ডে কিছু কিনে নিয়ে ডানাদের বাড়িতে যাই আমরা দুজনে মিলে। সারাদিন থেকে নিয়েল আমাকে সন্ধ্যায় নামিয়ে দিয়ে যায়। ওর সঙ্গে সিনেমা দেখি, অপেরাতে যাই, আর ঘরে সময় পেলেই ডেনিশ ভাষা রপ্ত করি। কথাটা শিখতে খুব বেশিদিন লাগে নি। কিন্তু লেখাপড়ায় যথেষ্ট সময় লেগেছে আমরা ঠিক করেছিলাম ঐ সামারে আগস্ট মাসের শেষের দিকে বিয়ে করবো। এর ভেতর বহুবার নিয়েলদের বাড়িতে গেছি। ওর বাবা প্রথিতযশা চিকিৎসক, মা আমারই মতো নার্স থেকে এখন মিডওয়াইফ-এ তো আর আমার দেশ নয়! নার্স, মিডওয়াইফ এদের যথেষ্ট সম্মান সমাজে। বড় এক বোন আছে ওর। বিয়ে করে ওরা এখন অ’লিয়াতে ঘর করছে। ছোট ভাইও ডাক্তার। যখন তখন ওদের বাড়িতে যাই। আমি ওদেরই একজন। ওর বাবা-মা সব বিবেচনা করে ১৬ আগস্ট বিয়ের দিন ঠিক করলো! মহাসমারোহে যখন বিয়ের পর প্রকৃত বীরাঙ্গনার গর্ব নিয়ে মধুচন্দ্রিমায় গেছি তখন সেই ছোট কুঙ্কাননে বিবিসির সংবাদে শুনলাম বঙ্গবন্ধু নেই। মনে আছে নিয়েলের বুকে মাথা দিয়ে আমি শিশুর মতো কেঁদেছিলাম আমার পিতৃবিয়োগের ব্যথা-বেদনায়। উনি আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, এই বীরাঙ্গনা তুই আমার মা। সে মুখ আমি আজও ভুলি নি। আমি বঙ্গবন্ধুর মা এই অহংকারই আমাকে জীবনযুদ্ধে জয়ী করেছে। ভাবলাম-না, নিজেকে আর বাঙালি বলে পরিচয় দেবো না। আমরা পিতৃহন্তা!