সমস্ত শক্তি দিয়ে আমি নার্সিং-এর কাজ করে যাই। ডাক্তার দেখলেই হাসিমুখে উৎসাহ দেন, সবার কাছে আমার অকুণ্ঠ প্রশংসা করেন। তারপর একদিন আমাকে জানালেন পোল্যান্ডে নার্সিং শিখবার জন্য তিনি একটি বৃত্তি যোগাড় করেছেন। আমাকে একটা আবেদনপত্র দিলেন পূরণ করে দেবার জন্য। পরদিন আমাদের বোর্ডের চেয়ারম্যান বিচারপতি সোবহানের কাছে আমাকে নিয়ে গেলেন এবং একখানা সুপারিশপত্রও চাইলেন। চেয়ারম্যান সাহেব খুবই সহানুভূতিপূর্ণ ব্যবহার করলেন।
হঠাৎ একদিন আমাকে বললেন, তারা, শিগ্গির তৈরি হয়ে এসো, আমার সঙ্গে স্বাস্থ্য দপ্তরে যেতে হবে। উত্তেজনায় আমার হাত-পা কাঁপছিল। এ মাসে এ আমার দ্বিতীয়বার পথে বেরুনো। একবার গিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুর ওখানে গণভবনে আর এবার সেক্রেটারিয়েটে। ইন্টারভিউ হলো। আমি কিছুতেই বাবার নাম বললাম না। ভদ্রলোক সব বুঝলেন, তবে আবেদনপত্রে নামটি লিখেছি। বাইরে এসে ডাক্তার শক্ত করে আমার হাত ধরলেন। বুঝলাম আমার দরখাস্ত মঞ্জুর হয়েছে। এক মাসের ভেতর আমার ছাড়পত্র এসে গেল। সব খরচ এরা দেবেন। যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত বলে কিছু বিশেষ সুবিধাও দেবে। জুলাইমাসের এক বিকেলে আমার আপন বলতে যা ছিল অতীতের সঙ্গে সব অতল জলে ডুবিয়ে দিয়ে আমি এয়ারফ্লোটে উঠে বসলাম। অন্তরে উচ্চারণ করলাম, ‘জয় বাংলা’, ‘জয় বঙ্গবন্ধু’। তোমার দেওয়া বীরাঙ্গনা নামের মর্যাদা আমি যেন রক্ষা করতে পারি। একদিন আমি মাথা উঁচু করে এসে তোমাকে সালাম জানিয়ে যাবো। না, মাথা উঁচু করে বহুবার এসেছি, কিন্তু তোমাকে সালাম করতে পারি নি। তুমি তখন আমার স্পর্শের অতীত।
আপা আপনাকে বিরক্ত করছি নাতো? বিস্ময়ে চমক ভেঙে বললাম– না, না বলো, আমি এতো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম যে মনে হচ্ছে আমিও সেই ’৭৩ সালে তোমার সঙ্গে এসেছি। সোফিয়া আমার খুব ভালো লেগেছিল। সুন্দর দেশ, দেশবাসীর ব্যবহার সুন্দরতর। আমাদের মতোই অতিথি পরায়ণ ওখানে বাংলাদেশের ছেলেমেয়েও দেখলাম। অনেকেই মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত বলে এখানে আসার সুযোগ পেয়েছে। কিন্তু ধীরে ধীরে ঘনিষ্ঠভাবে মিশে দেখলাম অধিকাংশই বিত্তশালীর পুত্র-কন্যা, তারা সুযোগের সদ্ব্যবহার করেছেন। কিছু ছিল রাজনৈতিক নেতাদের আত্মীয়-স্বজন, এমনকি পুত্র-কন্যাও। আমার মতো আঘাতপ্রাপ্ত এখানে কেউ আসে নি অর্থাৎ আসবার পথ পায় নি। আমার সব কৃতজ্ঞতা ওই ডাক্তারের কাছে। আচ্ছা আপা, আপনারা কি আমার মতো কাউকে বিদেশে যেতে সাহায্য করেছেন। মাথাটা নত হলেও সত্যি কথা বললাম না, কারণ এমন কেউ আমাদের কাছে সাহায্য চাইতে আসে নি। কেন? আপনি, বাসন্তীদি, মমতাজ বেগম-আপনারা তো সব সময়েই বোর্ডে আসতেন, তবে কেন এ ধরনের চেষ্টা করেননি? তারা, দেশ ছেড়ে যাবার মতো মানসিক প্রস্তুতি সম্ভবত তাদের ছিল না। মাটি আর মানুষকে ভালোবেসেই তারা ওখানে থাকতে চেয়েছিল। বঞ্চনার স্বরূপ তখনও তারা দেখে নি। যা তোমার কথাই বলো।
মাস তিনেকের ভেতরই একটি বাঙালি মেয়ে আমার পেছনে লাগলো। জানি না কিভাবে জেনেছে, অথবা আমার আচার আচরণ, মন-মানসিকতা থেকে বুঝেছে আমি সহজ স্বাভাবিক পরিবার থেকে আসি নি। আমার কোনও চিঠিপত্র এ তিনমাসে আসে নি। ঠিকানা জিজ্ঞেস করলে এড়িয়ে যাই। সুতরাং আমি ভালো মেয়ে নই। দু’এক করে কথাটা ইন্সটিটিউটে ছড়ালো। পোলিশ ছেলে-মেয়েরা আমাকে কেউ জিজ্ঞেস করে নি, কিন্তু অতিরিক্ত শ্রদ্ধা দেখিয়েছে। আমি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত ছিলাম, তাই গর্বভরে মনে মনে উচ্চারণ করতাম আমি বীরাঙ্গনা। পরে একটি বাঙালি ছেলে বললো যে ঐ মেয়েটি একজন মুসলিম লীগ নেতার মেয়ে। দেশে ফিরে যাবার অসুবিধা তাই নিজের ভোল পাল্টে একজন আওয়ামী লীগ কর্মীকে ধরে ঐ মেয়েকে এখানে পাঠিয়েছে। দেখো না ও পড়ালেখা কিছুই করে না। দেশের অবস্থা শান্ত হলেই ফিরে যাবে। ছেলেদের কাছ থেকে অবশ্য খারাপ ব্যবহার পাই নি।
পরের বছর হাতে কিছু টাকা জমলো। ভাবলাম দু’একটা দেশ দেখবো আমার সঙ্গে ডেনমার্কের এক মেয়ে পড়তো ও আমাকে ওর দেশে আসবার জন্য আমন্ত্রণ জানালো। বললো শুধু প্যাসেজ মানি ছাড়া তোমার আর কিছু লাগবে না। আমাদের সঙ্গেই থাকতে পারবে। ডানার কথায় নেচে উঠলাম। ১৯৭৪ সালের আগস্ট মাসে আমি ডানার সঙ্গে কোপেনহেগেনে পা রাখলাম। ওর বাবা এয়ারপোর্টে আমাদের নিতে এসেছেন। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে ভরে দিলেন। আমার সঙ্গে হাত মেলালেন হালকা করে। চুমুও দিলেন ডানার বাবা মি. হ্যারি, খাটো কিন্তু বেশ সুঠাম স্বাস্থ্যবান দেহের অধিকারী। তবে তার চুল বেশ হালকা-মাঝখানে টাক আলো পড়লে বোঝা যায়। তবে কেশের দৈন্য পুষিয়ে নিয়েছেন লালচে মোটা গোঁফে একখানা পিক আপ ভ্যানে এসেছেন ওর বাবা। ওদের গ্রাম শহর থেকে মাত্র বাইশ কিলোমিটার দূরে। বাবা-মেয়ে অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে নিজেদের ভাষায়, যার একবর্ণও আমি বুঝি না। আমি বাইরে তাকিয়ে একটা অনন্ত নীল আকাশ, শ্যামল বনানী আর আমারই মতো উড়ে যাওয়া কটা পাখি দেখলাম।
বাড়িটা আমার খুব পছন্দ হলো। দেড়তলা বাড়ি। পাকা গাঁথুনি তবে ছাদটা আমাদের দেশের টালির ছাদের মতো ঢালু। ওটা শীতের দেশের উপযোগী করে করা যেন বরফ না জমে। দেড়তলায় নিচু ছাদের একটা ঘর। দু’পাশে হালকা দুটো খাট বিছানো। সম্ভবত আমি আসবে বলে ঠিক করে রাখা হয়েছে। টয়লেট অবশ্য একতলায়। সামনে দু’পাশে বেশ জমি এবং জমির সীমানায় একটি ছোট্ট ঘর। যাই হোক, হাত ধুয়ে, লাঞ্চ খেতে বসলাম। ডানার মা, বাবার তুলনায় একটু বয়স্কা মনে হয়, বছর ষোলো বয়সের এক ভাই আর বছর চারেকের সবচেয়ে ছোট ভাই। ডানার বাবা ব্যাংকে কাজ করেন মা স্কুলের শিক্ষিকা। বড়ভাই সামনের বার স্কুল ফাইনাল দেবে আর ছোটটা একেবারে কিন্ডারগার্টেনে। বড়ভাই সম্ভবত উইলিয়াম, ছোটটির নাম স্যালী। ওর মা বলেলন, ও কিন্তু জন্মেছিল তোমার দেশে। আমরা যখন ওকে নিয়েছি তখন এর বয়স সতেরো দিন, তাইনা? বলে স্বামীর সমর্থন চাইলেন। খাওয়া খুব সাদাসিধা। রুটি, বাঁধাকপি আছে সেদ্ধ আলু দিয়ে বিরাট একটা কাঁচের বাটি ভর্তি সালাদ, আর পাতে বিফস্টেক। সঙ্গে ওয়াইন, তবে উইলিয়াম আর স্যালীকে দুধ দেওয়া হলো। খাবার পর একটু বিশ্রাম নিতে গেলাম।