ইত্যবসরে আমার গর্ভপাত করানো হলো। আমি কঠিন মুখে প্রস্তুতি নিলাম। কারণ এতোদিনে নিজের অবস্থান বুঝতে পেরেছি। আপা, আপনি তো দেখেছেন মেয়েরা কিছুতেই গর্ভপাতে রাজি হয় নি। সন্তান আঁকড়ে ধরে রাখতে চেয়েছে। নারীর প্রচণ্ড দুর্বলতা, কারণ জীবনে মা হবার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি নারীর সহজাত কামনা। কিন্তু এ সন্তান নিয়ে যাবো কোথায়? আপনার মনে আছে মর্জিনার কথা? সেই যে, পনেরো বছরের ফ্রক পরা মেয়েটি, যে কিছুতেই তার ছেলেকে বিদেশে পাঠাতে চায় নি। আপনাকে দেখলেই চিৎকার করতো ওর ছেলে চুরি করবেন এই ভয়ে। শেষপর্যন্ত ছেলেকে পাঠানো হলো। কিন্তু তারপর আপনি আর ওখানে বিশেষ আসতেন না, কেন আপা? আপনার কি কষ্ট হয়েছিল? মাথাটা নামিয়ে বললাম, তারা আমি এ জীবনে যতো কঠিন কাজ করেছি মর্জিনার ছেলেকে সুইডেনে পাঠানো বোধহয় তার ভেতর সবচেয়ে কষ্টদায়ক। বঙ্গবন্ধুকে যখন বলেছিলাম উনি বললেন, ‘না আপা, পিতৃপরিচয় যাদের নেই সবাইকে পাঠিয়ে দেন। মানুষের সন্তান মানুষের মতো বড় হোক। তাছাড়া ওই দূষিত রক্ত আমি এদেশে রাখতে চাই না। ওদের খ্রিস্টান করে নেবে এই বলে অনেক পরামর্শদাতা বঙ্গবন্ধুকে নিবৃত্ত করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেন নি। আমি পৃথিবীতে একাই লড়াই করবার জন্য প্রস্তুত হলাম।
হঠাৎ বাবা এলেন। বাবা যেন এক বছরে কেমন বুড়ো হয়ে গেছেন। দু’হাত শক্ত করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলেন। ঠিক একদিন এমন করে আমরা ৭৮ জন বঙ্গবন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলাম অফিসের মাধ্যমে। সেদিন আমাদের চোখের জলে বঙ্গবন্ধুর বুকটা ভিজে গিয়েছিল। বলেছিলেন, ‘তোরা আমার মা, জীবনের শ্রেষ্ঠ ধন স্বাধীনতার জন্য উৎসর্গ করেছিস। তোরা শ্রেষ্ঠ বীরাঙ্গনা। আমি আছি, তোদের চিন্তা কি? সত্যিই সেদিন মনে হয়েছিল আমাদের বঙ্গবন্ধু আছেন, আমাদের চিন্তা কি? কিন্তু বাবার বুকে তে সে অশ্রুপাত করতে পারলাম না। আমার মাথায় রাখা বাবার হাতও তো তেমন কোনও আশ্বাস দিলো না। মুখ তুলে বললাম– বাবা এখন কি তোমার সঙ্গে আমি যাবো? অফিসে বলতে হবে। বাবা একটু থেমে ইতস্তুত করে বললো, না, আজ তোমাকে আমি নিতে পারবো না। বাড়িঘর মেরামত হচ্ছে। তোমার মামাও এসেছে। কালী আসবে জামাইকে নিয়ে। ওরা চলে গেলে আমি তোমাকে নিয়ে যাবো মা। আস্তে করে বাবার বাহুবন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে নিলাম। ঠিক আছে বাবা তুমি আর এসো না। বাবা না, না বলে আমতা আমতা করতে লাগলেন। আমার হাতে একটা ফলের ঠোঙা দিলেন। ওটা স্পর্শ করতে মন চায় নি। কিন্তু ফেলে দিয়ে নিজেকে হাসির পাত্র করতে চাইলাম না। বাবা আবারও এসেছেন, কিন্তু আমাকে নেবার কথা বলেন নি। দাদা এসেছে কলকাতা থেকে আনা শাড়ি নিয়ে। এমন কি শ্যামলদাও এসে বীরাঙ্গনা দেখে গেছে। দাদা অবশ্য একটা কথা বলে গেলেন যা বাৰা মুখ ফুটে বলতে পারে নি। দাদা বললো, তারা, আমরা যে যখন পারবো তোর সঙ্গে দেখা করে যাবো। তুই কিন্তু আবার হুট করে বাড়ি গিয়ে উঠিস না। আমার মুখের পেশিগুলো ক্রমশ শক্ত হয়ে আসছিল। দাদা সে-দিকে এক নজর তাকিয়ে চট করে বললেন, তাছাড়া আমাদের ঠিকানায় চিঠিপত্র লিখিবারও দরকার নেই। তুই তো ভালোই আছিস। আমিও চাকুরি পেয়েছি, সরকার থেকে ক্ষতিপূরণ পেয়েছি তা দিয়ে বাড়িঘরও মেরামত হয়েছে। ওপরে দুটো ঘরও তোলা হয়েছে। হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালাম, ওর দিকে আর তাকাই নি। তারপর যখন দাদার সঙ্গে দেখা হয়েছে তখন আর আমি হতভাগিনী তারা নই, গর্বিতা মিসেস টি. নিয়েলসেন।
আমার জিভ শুকিয়ে আসছে। তারার গ্লাসটা ভরে দিয়ে নিজেরটাতেও চুমুক দিলাম। আমাকে জিজ্ঞেস করতে হলো না, ও নিজেই একটু থেমে আবার শুরু করলো, আমার ভেতর প্রচণ্ড একটা ঘৃণা ও জেদ এক সঙ্গে কাজ করছিল মনুষ্যত্বের অপমৃত্যু দেখে। মর্জিনা বলেছিল ওর স্বামী সরকার থেকে ওর এ অবস্থার জন্যে টাকা পেয়েছে। বাবা, দাদাও কি তাহলে আমার সতীত্ব-মাতৃত্বের দাম নিয়েছে সরকারের কাছে থেকে। বাড়ি মেরামত করেছে, ওপরে ঘর তুলেছে, ওরা ও ঘরে থাকবে কি করে? তারা নামের একটি মেয়ে আঠারো বছর যে বাড়ির প্রতিটি ধূলিকণার সঙ্গে মিশে ছিল তাকে ওরা অনুভব করবে না? অথচ আমি তো চোখ বুজলেই পশ্চিম কোণের বৃষ্টি ধোয়া কদমফুলের গাছটা দেখতে পাই। চৈত্র-বৈশাখে মালদার আম গাছের মৌলের সৌরভ বাতাসে উপলব্ধি করি। না, বাস্তব বড় কঠিন। আমি বীরাঙ্গনা, আমাকে নিজের পায়ের ওপর ভর করে দাঁড়াতে হবে। সেই যে পোলিশ মহিলা ডাক্তার যিনি আমাকে মাতৃত্বের সর্পবেষ্টনী থেকে মুক্ত করেছিলেন, যার সঙ্গে আমি অজি ছমাস কাজ করছি তাকে শক্ত করে ধরলাম। আমাকে উনি কোনও রকমে বিদেশে যাবার একটা ব্যবস্থা করে দিতে পারেন কিনা। বাইরে যেতে না পারলে আমি মরে যাবো। এ সমাজ আমাকে গ্রহণ করবে না। আমার পরিবারের সব আচরণ আমি ওঁকে খুলে বললাম। উনি স্তম্ভিত হলেন। ব্যথায় ওর সুন্দর মুখখানা ম্লান হলো। আমাকে কাছে নিয়ে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, সাহস হারিও না, তুমি একজন মুক্তিযোদ্ধা। তুমি তো জানো না, পঙ্গু হাসপাতালে কতো তরুণ চিরকালের জন্য বিছানা পেতেছে। আমি তোমার জন্য চেষ্টা করবো মাই চাইল্ড। একটু ক্লান্ত পায়ে এগিয়ে গেলেন। ওঁর শাড়িপরা হালকা শরীরটা ধীরে ধীরে চেয়ারম্যানের ঘরে অদৃশ্য হয়ে গেল। আমি বুঝলাম ওঁকে দিয়ে যা করাবার দ্রুত করাতে হবে কারণ ওঁরা আর চারমাসের বেশি থাকবেন না। গর্ভপাতের রুগী শেষ হয়েছে, এখন তো সন্তান প্রসব করানো, সে তো দেশী ডাক্তার দিয়েও হবে।