পরদিন শফিককে বললাম, আজ আমি চা খাওয়াবো চলো। শফিক উৎফুল্ল মেজাজেই চললো। চা নাশতা সামনে নিয়ে বললাম, শফিকআগে খেয়ে নাও তারপর আমার কাহিনী শুরু করবো। কারণ আমি তোমার মতো ভালোমানুষ নই। শফিক খাবারে হাত দিলো। মিনা ওর হাতটা চেপে ধরলো, ওকি? অমন করে খাচ্ছ কেন? তুমি হুকুম করলে তাই। মিনা হেসে ফেললো, বেশ খাও। খাওয়া শেষ হলে শফিক একটা সিগারেট ধরালো, তারপর সুখটান দিয়ে বললো, কে আরম্ভ করবে, তুমি না আমি? না না তুমি তো কাল বলছো, আজ আমার পালা। তোমার অনুমতি পেলে আজকের পালাটাও আমি গাইতে পারি-ওপর দিকে চোখ তুলে বললো শফিক। তার মানে? মিনার কণ্ঠে বিস্ময়। তাহলে শোনো, মিনা নামে মালিবাগে এক দুরন্তু মেয়ে ছিল। বিয়ে হলো তার হাসনাত নামের এক ভদ্রলোকের সঙ্গে যিনি অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করেন। তাদের একটি ফুটফুটে সুন্দর মেয়ে হলো নাম তার ফাল্গুনী। মিনা হা করে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দেশে বর্গী এলো, মিনাকে বৰ্গীরা ধরে নিয়ে গেল, তাদের কয়েদখানায় চারমাস আটকে রাখলো। মিনা শফিকের হাতটা জোরে চেপে ধরলো। শফিক ধীরে ধীরে তার হাতটা আলগা করে বলে চললো, তারপর মেয়েটি বন্দিশালা থেকে মুক্তি পেলো। কিন্তু অপবিত্র আখ্যা দিয়ে স্বামী তাকে ঘর থেকে বের করে দিলো। স্বামী ততদিনে অন্য নারীতে আসক্ত হয়ে পড়েছে। মেয়েটি শাশুড়ি দেওরের কাছে সন্তান রেখে সরকারি সহায়তায় পড়াশুনা করলো, চাকুরি নিলো। এখন বেশ ভালোই আছে তবে একটি সূক্ষ্ম বেদনার কাঁটা, মেয়েটি তার কাছে থাকে না। কিন্তু তার ছোট বোনের সঙ্গে দেওরের বিয়ে হয়েছে। মেয়েটি চাচা চাচীকেই বাবা মা জানে। তাদের সুখের সংসারে আরেকটি মেহমান এসেছে ছেলে। কিন্তু দু’জনে সমান আদরে বড় হচ্ছে। এখন কথা হচ্ছে… স্থান কাল ভুলে গিয়ে মিনা শফিকের মুখ চেপে ধরলো। শফিক থেমে বললো, কোনও রকম ভুল-ভ্রান্তি হয় নি তো? হুবহু বলতে পেরেছি? জ্বী, একেবারে দশে দশ বললে মিনা। কিন্তু তোমাকে এসব কথা কে বলেছে? ছোট? না মিনা, বড়ই এসে বলেছেন অনুগ্রহ করে। তোমার মতো বাজে মেয়ের থেকে যেন দূরে থাকি আমি। দূরে গেলে না কেন? উৎসুক দৃষ্টিতে জিজ্ঞাসা করে মিনা। সবার বিচার তো একরকম হয় না। তার কাছে যে খারাপ আমার কাছে সে শুধু ভালো নয়, খুব বেশি ভালোও তো হতে পারে। চলো আজ উঠি। মার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই। দরকার হলে ডাক্তার ডাকবে। আমি আসবো তোমার সঙ্গে, জিজ্ঞেস করে মিনা। এলে খুশি হবো। খুশি মনে দু’জনেই একটা রিকশায় বসলো। এক রিকশায় দু’জনেই এই প্রথম।
এরপর আর দেরি হয় নি। মনী ও হায়দারের বলে এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে রেজিস্ট্রি করে একেবারে শফিকের বাড়িতে উঠেছে। ওর মা আগে থেকেই খুব খুশি ছিলেন। এখন আনন্দে আত্মহারা হলেন। বীরাঙ্গনা মিনার সংগ্রাম শেষ হলো। কিছুদিন আগে এক বিয়ে বাড়িতে দেখা। ওর সঙ্গে অবশ্য প্রায়ই আমার দেখা হতো বেইলী রোড় কর্মজীবী হোস্টেলে। আমার ভগ্নীতুল্য বান্ধবী জেরিনা তখন ওখানে কাজ করতো। মাঝে মাঝে ওর ঘরে গিয়ে বসতাম। চোখ নিচু করে মিনা বেরিয়ে যেতো অথবা ঘরে ঢুকতো। কিছু জিজ্ঞেস করলে খুব কুণ্ঠিতভাবে জবাব দিতো। বলতাম, জেরিনা এই মেয়েগুলোর বুকে আগুন জ্বেলে দিতে পারিস না, ওরা কেন মাথা নিচু করে চলে? নীলিমাদি তোমাদের এ সমাজ ওদের চারিদিকে যে আগুন জ্বেলে রেখেছে তার উত্তাপেই ওরা মুখ তুলতে পারে না। বেশি বেশি বক্তৃতা দিও না। ওদের সম্পর্কে জেরিনা খুব বেশি স্পর্শকাতর ছিল। তবে জেরিনা ওর বিয়ের খবর শুনে গিয়েছিল এবং ওদের একদিন নিজের বাড়িতে দাওয়াত করে খাইয়েছিল। আমার কিন্তু সেটুকু সৎ সাহস বা আগ্রহ হয় নি। মিনা যেনো আগের চেয়েও সুন্দরী হয়েছে। খোঁপায় ফুল, একটা হাল্কা নীল রঙের সিল্কের শাড়ি পরেছে। রূপে যেন দশদিক আলো হয়ে গেছে। খুব ব্যস্ত। বছর দশেকের একটি মেয়েকে আমার কাছে। এনে বললো, সালাম করো খালামনি। আপা, এ শ্রাবণী আমার মেয়ে। সেই মুহূর্তে আমার মনে পড়লো ওর তো ফাল্গুনী নামে একটি ফুটফুটে মেয়ে ছিল। নিজেকে সংযত করলাম। বললাম, কার বিয়েতে এতো ব্যস্ত তুমি? কানের কাছে মুখ নিয়ে বললো, আমার মেয়ের, আর জোরে বললো, আপা আমার দেওর আর বোনের বড় মেয়ে ফাল্গুনীর বিয়ে। আনন্দ বেদনায় মিনার চোখে বান ডেকেছে। উঠে দাঁড়িয়ে ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ মুছে বললো, দোয়া করবেন মায়ের দুর্ভাগ্য যেন ওকে স্পর্শ না করে। কঠিন গলায় বললাম, দুর্ভাগ্য? কি বলছো তুমি মিনা। ঠিকই আপা, আমি মাফ চাই। আমি বীরাঙ্গনা, মহাপুরুষের বাক্য ব্যর্থ হয় নি। আজ আমি মাতৃগর্বে গর্বিত এক মহিয়সী নারী। আপা আমি খুব খুশি। মিনা পা ছুঁতে গেল। ওকে তুললাম। বহুদিন পর হৃদয়ের একটা বোঝা কমে গেল। তাহলে এ বাংলাদেশে এখনও সৎ মানুষ আছে যারা মিনার মতো মেয়েকে নিয়ে সুখের নীড় রচনা করবার স্পর্ধা ও সাহস রাখে। মনে মনে উচ্চারণ করলাম ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়।’