এসময় চা দিয়ে গেল কাজের মেয়েটা। চা খেতে খেতে শফিকের মা অনেক কথা বললেন। বললেন, দেখো তো মা, তার ভাঙা মন সে আর বিয়ে করবে না, কি এমন হয়েছে? এমন তো সব ঘরেই হচ্ছে এখন। তোমরা তো একসঙ্গে কাজ করো। একটু বুঝিয়ো তো মা। শফিককে আরোগ্য লাভের শুভেচ্ছা জানিয়ে মিনা বেরিয়ে এলো। হায়দারকে ছেড়ে দিয়ে নিজেই একা রিকশা নিয়ে হোস্টেলে ফিরে এলো। কি হয়েছে শফিকের পরিবারে যেজন্য সে বিয়ে করতে চায় না। যাকগে আমি মরছি নিজের জ্বলায়। হোস্টেলে ঢুকতে ঢুকতে ভালো তিনবছর তো হয়ে এলো। এ বছরে তো হোস্টেলও ছাড়তে হবে। একটা এক ঘরের ফ্ল্যাটের চেষ্টা করতে হবে।
শ্রান্ত ক্লান্ত দেহ ও মন নিয়ে বিছানায় এলিয়ে পড়লো। কখন ঘুমিয়ে পড়েছে জানে না, কেউ একজন বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে গেছে। ঘড়িতে তিনটা। উঠে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলে আবার শুয়ে পড়লো সে। ঘুম ভাঙলো সাড়ে সাতটায়। কোনও মতে স্নান সেরে তৈরি হয়ে অফিসে ছুটলো সে। ফোন এলো শফিকের কাছ থেকে, আজ যেতে বলেছে। মিনা বললো, আজ সম্ভব হবে না। অনেক কাজ, কাল যাবে। ইচ্ছে করে সে সময় নিলো। তাছাড়া সত্যিই আজ তার বিশ্রাম প্রয়োজন নইলে সে অসুস্থ হয়ে পড়বে। আজ তার মনে পড়ছে গত সপ্তাহে শনিবার বিকেলে সে আর শফিক যখন অফিস থেকে বেরুচ্ছিল তখন আরও দু’তিনটা লোকের সঙ্গে সে হাসনাতকে যেন দেখেছিল। ঐদিন সে ঠিক বিশ্বাস করতে পারেনি। কিন্তু কাল সে নিশ্চিত যে হাসনাত শফিককে চেনাবার জন্য হয়তো নিজেই এসেছিল, কিন্তু কেন? স্ত্রী-সন্তানকে পথে ফেলে দিয়ে যেমন ইচ্ছে একজনকে ঘরে নিয়ে সুখেই তো আছে সে। তার ওপর আমি সুখী হতে চাইলেই তার আক্রোশ? না, মিনা এবারে বাবার কথাই শুনবে। দেখি শফিকই বা কি বলে। হায়দার বলা সত্ত্বেও মিনা আর শফিকদের বাড়িতে গেলো না। ওর মার এক কথা, ও আর বিয়ে করতে চায় না। তাহলে কি শফিক বিবাহিত? স্ত্রী জীবিত না মৃত? কে জানে দেখি না শফিক তাকে কিছু বলে কিনা। মনে হয় বলবে কারণ কদিন আগেই তাকে দু’একদিন বলেছে, চলো মিনা আমরা কোথাও যাই একটু বসে গল্প করি। তোমাকে যে আমার অনেক কিছু বলার আছে। মিনা গায়ে লাগায় নি। শুধু শুনেছে ওর বাবা ডেপুটি সেক্রেটারি ছিলেন। মাত্র বায়ান্ন বছর বয়সে জিপ এ্যাক্সিডেন্টে মারা যান। ওরা দুই ভাই আর মা। মা একটা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা। পরবর্তীতে বাবার রেখে যাওয়া টাকা পয়সা এক করে ঐ ফ্ল্যাটটা কিনেছেন। তাকে মানুষ করেছেন। ছোট ভাই এমবিএ পড়ে আগামী বছর পাশ করে বেরুবে, তারপর আর তাদের কোনও সমস্যা থাকবে না। মিনা বোঝে তাকে এসব কথা বলবার অর্থ কি? এও এক রকম চাকুরির দরখাস্তের সাথে বায়োডাটা দেওয়া। মিনা সবই বোঝে কিন্তু আজও পথ খুঁজে পাচ্ছে না।
দিন দশেক পর শফিক জয়েন করলো। মুখটা বেশ ভার। মিনা বোঝে শফিকের এ সঙ্গত অভিমান। আস্তে আস্তে মেঘ কেটে গেলো। শফিকই তাকে চায়ের দাওয়াত করলো। কিছুটা হেঁটে গিয়ে দূরে একটা রেস্তোরাঁয় বসলো ওরা। চা সামনে নিয়ে শফিকই কথা শুরু করলো, মিনা, আজ তোমাকে একটা কথা বলা আমি খুবই সঙ্গত মনে করছি। কারণ আমি তোমার কাছে একটা আবেদন করবো তার আগে আমি নিজেকে তোমার কাছে পরিচ্ছন্নভাবে তুলে ধরতে চাই। মিনা, আমি বিবাহিত। একটু যেন চমকে উঠলো মিনা, দৃষ্টি প্রসারিত করে যেন শফিককে ভালো করে দেখতে চেষ্টা করলো। দু’বছর আগে আমি সালেহাকে বিয়ে করি। মন জানাজানি শুরু হয় তারও আগে। অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়ে বলে প্রথমটা মায়ের আপত্তি ছিল। পরে অবশ্য ওর ব্যবহারে মানিয়ে নিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়ের পর, সালেহা মাকে ঠিক সইতে পারলো না। পদে পদে মাকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে লাগলো, আমার মুখের দিকে চেয়ে মা সবই সয়ে গেলেন। শেষে না পেরে একদিন আমাকে বললেন, শফিক তুই আলাদা বাসা নে। আমাদের গরিবী হাল বৌমার ঠিক পছন্দ হচ্ছে না। আমি চমকে উঠলাম, তা হয় না মা, তুমি যে কঠোর পরিশ্রম করে আমাদের মানুষ করেছে, আজ তোমাকে ফেলে যাবো আমি? কিন্তু বাবা, আমিও তো আর পারছি না। তোর বাবা আমাকে হীরা জহরৎ না দিতে পারেন, কিন্তু কোনও দিন অসম্মান করেন নি। শফিক নত মস্তকে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো অফিস থেকে ফিরে এসে চা খাবার সময় সালেহাকে বলতেই সে বারুদের মতো ফেটে পড়লো। মায়ের ব্যাপার নিয়ে প্রচন্ড রকম কথা কাটাকাটি হলো। শেষে মা এসে ওদের শান্ত করলেন। বললেন, বউমা, কোনও রাগ বা ক্ষোভ থেকে বলছি না, এ বাড়ি আমার। আমি পথে পা দেবোনা। শফিক উপার্জনক্ষম তাই তাকে বলেছি তোমাকে নিয়ে অন্য কোথাও থাকতে। আমি বুঝতে পারছি তুমি আমাকে সহ্য করতে পারছে না। যখন তখন অপমান করছে। আমার আরেকটি ছেলে আছে সে যদি তোমাকে অপমান করে সেটা হবে আমার জন্য আত্মঘাতী। তাই একথা বলছেন, উত্তর দিলো সালেহা, আপনারা অর্থের দিক থেকে দরিদ্র এটা জানতাম, কিন্তু আপনাদের মন এতো ছোট তা আমার জানা ছিলো না। আমি আজই মায়ের বাড়িতে চলে যাবো। মা হাতে ধরে সাধতে গেলে হাত ছেড়ে আনতে গিয়ে মাকে একটা ধাক্কা দিলো। মা পড়ে গেলেন। দু’ভায়ে মাকে ধরে তুলে তার ঘরে নিয়ে গেলাম। আমার ঘরে এসে দেখি সালেহা নেই। পরে একদিন আমি অফিসে থাকা অবস্থায় এসে তার জিনিসপত্র সব নিয়ে গেল। মাসখানেক পর আমি তালাকের চিঠি পেলাম। নিঃশব্দে তাকে মুক্তি দিয়েছি কারণ আমার মায়ের অপমান সহ্য করা আমার জন্য যেমন কঠিন, মাকে ছেড়ে যাওয়া কঠিনতর। প্রায় চার বছর হয়ে গেল আমাদের জীবন এভাবেই চলে যাচ্ছে মিনা। সব শুনেও যদি তুমি আমাকে গ্রহণ করে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করবো। সেদিন ওখানেই শেষ হলো।