হায়দার অর্থাৎ আমার দেবর, ছোট খোকা, বিকম পাশ করলো বেশ ভালোভাবে? আমার ব্যাংকের কর্তৃপক্ষকে ধরলাম। জানালাম আমার সন্তানের লালন পালনের দায়িত্বভার তারা নিয়েছে। ওনারা সব শুনলেন এবং ছোটখোকাও চাকুরি পেয়ে গেল। আমারই ব্যাংকে। এখন ওর সঙ্গে আমার ভবিষ্যত কর্মপন্থা সম্পর্কে পরামর্শ করার প্রয়োজন। দুজনে একটা রেস্তোরাঁয় বসলাম। বললো, ভাবি, এবার তো একটা বাসা। ভাড়া নিয়ে আমরা এক সঙ্গে থাকতে পারি। বললাম, পারি, কিন্তু থাকবে না। মাথাটা খুব নিচু করে বললো, ভাইয়া বিয়ে করেছেন, আমাদের বলে নি কিন্তু আমি জানি। জয়দেবপুরেরই একেবারে গ্রামের এক রাজাকারের মেয়ে। ঐ সময় সে ও বাড়িতেই ছিল। তাই আজ মিনার ভাষায় সর্বতোভাবে সে ওদের কর্তা হয়েছে। মিনা মাথায় হাত দিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। সেই হাসনাত কি করে এমন হলো। ওই মায়ের ছেলে? না মিনা আর ভাবতে পারে না। হায়দার বললো, ভাবি, আজ না হয় এসব আলাপ আলোচনা থাক আরেক দিন হবে। ঠিক আছে, বলে টলতে টলতে উঠে দাঁড়ালো মিনা। বললো, ছোট চলো একবার ফাল্গুনীকে দেখে আসি, আমার কেমন যেন অস্থির লাগছে। তাই চলো অবি। মার অবস্থা ভালো না। খাওয়া দাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। কি হবে ভাবি আমাদের?
সারাটা পথ রিকশায় মিনা চুপ করে বসে রইলো। সমস্ত অতীত ভীড় করে এসে তার সামনে দাঁড়ালো। সেই বিয়ের দিন, তার পরের আনন্দের দিনগুলো। ফাল্গুনীর জন্মের পর সেই উল্লাস। সবই কি কৃত্রিম ছিল না, মেয়েদের জীবন নিয়ে একটা পুরুষ যা ইচ্ছে তাই করতে পারে। ইচ্ছে মতো তাকে ভোগ করেছে। নতুন খেলনা পেয়ে পুরাতনকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে। সে কোথায় পড়লো, ভেঙে কতো টুকরো হলো তার দিকে ফিরে তাকাবারও অবকাশ নেই। কিন্তু ও কি চিরদিন এমনিই থাকবে? নাঃ এসব কি ভাবছে মিনা? তার কাছে হাসনাত মারা গোছে দু’বছর আগে, নতুন করে এ হারাবার শোক কেন?
যথারীতি কড়া নাড়তে আম্মা এসে দরজা খুলে দিলেন। এ কি চেহারা হয়েছে আম্মার! রঙটা যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে, মাথার চুল মনে হয় অর্ধেক শাদা হয়ে গেছে। সে কতো দিন আসে না? মাত্র তে মাস ছয়েক হবে। ধীর পদে মিনা এগিয়ে এসে আম্মার হাত ধরলো। হঠাৎ পাঁচ বছরের শির মতো আম্মা ওর বুকে আছড়ে পড়লেন। আর কত শাস্তি তোমরা আমাকে দেবে বৌমা। বিষ খাইয়ে মেরে ফেলো! বুড়ো মায়ের প্রতি কর্তব্য করো। অনেক কষ্টে মিনা ওকে থামালো, জোর করে বসিয়ে দিলো। বললো, আম্মা, ও ওর কাজ করেছে আমরা আমাদের কাজ করবো। কালই বাসা দেখে আমরা জিনিসপত্র নিয়ে চলে যাবো। তারপর হায়দারের বিয়ে দিয়ে আপনার ঘর সাজিয়ে দেবো। ফাল্গনী থাকবে। আমি আসা যাওয়া করবো। অসহায়ভাবে আম্মা মিনাকে ধরে বললেন, তুমি যেও না বউমা, ও আমাকে মেরে ফেলবে। গতকাল এসেছিল, তোমার কাপড় চোপড় গয়নাগাটি নিয়ে যেতে চায়। গয়না আমি আগেই তোমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি, ওসব ফাল্গুনীর প্রাপ্য। আর জামা কাপড় সব তোমার বাবার দেওয়া। ওই পশু আমার গায়ে হাত দিয়েছে বলে আবার ডুকরে কেঁদে উঠলেন। শাশুড়িকে শান্ত করে মিনা আজ প্রায় তিন বছর পর বাবার বাড়িতে পা দিলো। সেখানে শুধু কান্না। আনন্দ, না দুঃখের মিনা বুঝতে পারছিল না। এই তিনবছরে মুন্নী অনেক বড় হয়েছে, সুন্দরও হয়েছে। ওর দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইলো মিনা। এ যেন দশ বছর আগেকার সে।
হায়দার বাইরের ঘরে ফাল্গুনীর সঙ্গে খেলছে, মুন্নী ওকে চা দিয়ে এলো। বাবা মার সঙ্গে অনেকক্ষণ আলাপ করে বললো, বড়ভাই এলে কথা বলো, তারপর আমাকে জানিও। বাবা তুমি এসো আমার হোস্টেলে। কোনও অসুবিধা নেই। দিন সাতেকের ভেতর ফার্মগেটের বাসা ছেড়ে রামপুরায় বাসা নেওয়া হয়েছে। মায়ের কাছাকাছি এসে আম্মাও অনেকটা ভালো আছেন। এদিকে মুন্নীর সঙ্গে হায়দারের বিয়ে হয়ে গেল। হাসনাতকে কেউ জানাবার প্রয়োজনও মনে করলো না। স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো মিনা। যাক-সবাই ঘর পেয়েছে। তাকে বাড়ি এসে থাকবার জন্য অনুরোধ করেছে হায়দার, আম্মা এমন কি বাবা-মাও অনেকবার বলেছেন। কিন্তু না, যে ঘর মিনা ছেড়ে এসেছে সেখানে সে আর ফিরে যাবে না।
অফিসে শফিক আর সে পাশাপাশি টেবিলে বসে। অনেকটা অন্তরঙ্গ হয়েছে, তারা নিছক বন্ধু, ঐ পর্যন্তই। একবার কতো সাহস যুগিয়েছে শফিক। কিন্তু মিনা জানে যেদিন তিনি তার সব পরিচয় পাবেন বিদ্যুৎ গতিতে সরে যাবেন। সে পুরুষকে যেটুকু চিনেছে তাতে এর থেকে মহৎ কোনও ধারণা পোষণ করবার কারণ সে খুঁজে পায় নি। তবুও সবাই যখন ঘর পেয়েছে তখন মিনার অবসরও একটু বেড়েছে বৈকি। একদিন শফিকের প্রস্তাব অনুসারে সিনেমাও দেখে এলো। কিন্তু বাইরে আসতেই একটা লোক কুৎসিৎ ইঙ্গিত করে সিটি বাজিয়ে উঠলো। শফিক এগিয়ে যাবার চেষ্টা করতেই মিনা তাকে ধরে ফেললো। ছিঃ ইতরের সঙ্গে ইতরামি করলে নিজের সম্মান থাকে একটু দূরে সে হাসনাতকে সরে যেতে দেখেছে। মরাল কাওয়ার্ডটা সামনে আসেনা কেন? দু’জনে এগিয়ে একটা বেবীতে চড়লো তারপর একেবারে হায়দারের বাসায়। আম্মা, মুন্নী খুব খুশি। ওরা টিভি দেখছিল বন্ধ করে দেওয়ায় ফাল্গনী কেঁদে ফেললো। মিনা একে একে আম্মা, মুন্নী ও হায়দারের সঙ্গে শফিকের পরিচয় করিয়ে দিলো। ফাল্গুনীকে বললো, তোমার আঙ্কেল শফিক চাচা। ফাল্গুনী হেসে এগিয়ে এসে বললো, শফিক চাচা, খুব ভালো, তুমি টিভি দেখো? বলতেই শফিক উঠে গিয়ে টিভিটা খুলে দিল। ফারুনী মহাখুশি কিছুক্ষণ গল্প করে, চা খেয়ে আবার আসবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে শফিক চলে গেল। মিনা রয়ে গেল। বহুদিন পর আম্মা ও ফাল্গুনীর সঙ্গে রাতে ঘুমালো। কাল শুক্রবার অতএব তাড়া নেই। শফিক রাতেই হোস্টেলে ফোন করেছে। ফারুনী স্কুলে ভর্তি হয়েছে। মুনী হায়দারের চোখের মণি। বাবা রোজ একবার আসেন ওর টানে। আম্মাও দু’একদিন পর পর ফারুণীকে এসে দেখে যান। বড় ভাইয়ার বিয়ের কথা চলছে। বাবা বলেছেন, এ বিয়েতে মিনা উপস্থিত থাকবে। ইতিমধ্যে হায়দারের কথায় এবং চেষ্টায় মিনা হাসনাতকে তালাক দিয়েছে, তা না হলে ওই পশুটা তার পেছন ছাড়তো না।