হাসনাত এখন বাড়ি থেকেই যাতায়াত করে। সেও গাজীপুর থেকে পালিয়ে একটা গ্রামে গিয়েছিল। স্বাধীনতার পর ফিরে এসেছে। এই বিরানপুরীতে আমি আর ছোট খোকা না খেয়ে না ঘুমিয়ে দিন কাটিয়েছি বৌমা। ওঃ! তাহলে বীরপুরুষও পালিয়েছিলেন! শুধু জিদ করে আমার কপালটা পোড়ালো। সন্ধ্যা হয়ে এসেছে। দরজায় কড়া নড়ে উঠলো, ভয়ে আশংকায় আমার বুকটা কেঁপে উঠলো। আম্মার গলা শুনলাম, বললেন, বড় খোকা দেখো কে এসেছে। দু’পা এগিয়ে আমাকে দেখে হাসনাত ফেটে পড়লো। বললো, তুমি এখানে কেন? মরবার জায়গা পাওনি? ঐ তো ধানমন্ডি লেকে কতো পানি, যাও। কোন সাহসে তুমি আমার বাড়িতে ঢুকেছে। আম্মা ওর মুখে হাত চাপা দিতে গিয়েছিলেন। ও ধাক্কা দিয়ে আম্মাকে ছোট খোকার গায়ের ওপর ফেলে দিলো। ভয় পেয়ে ফাল্গুনী মা, মা চিৎকার করে আমার দিকে হাত বাড্রালো। এক হেচকা টানে হাসনাত মেয়েকে সরিয়ে নিলো। না ও তোর মা নয়, ও এক ডাইনি, আমাদের খেতে এসেছে। এতক্ষণে আমি সম্বিত ফিরে পেলাম। শক্ত পায়ে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড একটা ধমক দিলাম। কাপুরুষ, লজ্জা করে না তোমার আমাকে এ কথা বলতে। কেন আমার বাবাকে ফিরিয়ে দিয়েছিলে? বলো, জবাব দাও? তারপর চাকুরি রক্ষা করতে ছুটলে গাজীপুর। সেখান থেকে শেয়াল কুকুরের গর্তে। ঘরে বুড়ো মা, শিশু কন্যা, স্ত্রী, যুবক ভাই সব ফেলে কেমন নিশ্চিন্তে দশ মাস কাটিয়ে এলে। ওই সময় কি করেছো না করেছো আমরা জানি? রাজাকার হয়েছিলে কিনা তাও তো বলতে পারবো না। যখন বিয়ে করেছিলে, আমার হাত ধরেছিলে, তখন কেন এ দায়িত্ব নিয়েছিলে? তুমি আমাকে তাড়িয়ে দিচ্ছো, কিন্তু আমি তোমাকে ঘরে থাকতে দেবো না। হঠাৎ ঘুরে ফাল্গুনীকে কোলে নিয়ে আমি বাইরের দিকে পা বাড়ালাম। হাসনাত আমাকে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে মেয়েকে কেড়ে নিলো। ছোট খোকা আমার হাত ধরে রাস্তায় পা দিলো। ওর মুখে কথা নেই, কিন্তু হাতটা শক্ত করে ধরা। রিকশা ডাকতেই আমি চোখ মুছে বললাম, ভাই আমি কিন্তু বাবার কাছে যাবো না। ছোট খোকা মাথা নিচু করে বললো, না ভাবি আমি তোমাকে সেখানে নেবো না। চলো ধানমন্ডি পৌঁছে দিয়ে আসি তোমাকে। অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি করে জানলে আমি ওখানে আছি। বিব্রত ছোট বললো, ওখান থেকে ভাইয়ার নামে চিঠি এসেছিল। আমি লুকিয়ে পড়েছিলাম। তারপর তোমার সঙ্গে দেখা করতেও গিয়েছিলাম। ওরা বললো তুমি হাসপাতালে অসুস্থ। তাই আর দেখা করে আসতে পারি নি। ভাবি আমি একটা চাকুরি পেলেই তোমাকে নিয়ে আসবো। যেমন চাকরিই হোক, পাবো নিশ্চয়ই একটি না একটি। ফাল্গুনীর জন্য ভোে না খালাম্মার কাছে ওকে রেখে আসবো। মুন্নী আছে, আমি আছি। মার জন্য বাড়ি থেকে চলে যেতে পারি, না হলে ভাইয়ার সঙ্গে এ বাড়িতে থাকতে আমার রুচি হয় না। বলতে বলতে পুনর্বাসন কেন্দ্রে পৌঁছে গেলাম। ও মাঝে মাঝে আমার খবর নেবে। আর মনে চাইলেই বাসায় যেতে বললো। আজ হঠাৎ ও কিছু বুঝতে পারে নি। কিন্তু ভবিষ্যতে এমন আর হবে না। তুমি আমাকে ক্ষমা করো ভাবি। ওর মাথায় হাত দিয়ে দোয়া করে মুখ ঢেকে দোতলায় উঠে গেলাম।
আশ্চর্যজনকভাবে রাতে ভালো ঘুম হলো। আগস্টের পর থেকে এমন নিশ্চিন্ত ঘুম আমি একরাতও ঘুমাই নি। সকালে শরীরটা খুব হাল্কা মনে হলো। মনে হয় সব বন্ধন আমি ছিন্ন করে এসেছি। আমি মুক্ত। আমি আমার নিজের। হয়তো বাবা-মায়ের ওপর অবিচার করলাম। কিন্তু নিজের স্বার্থে আমি মুন্নীর সর্ব সুখ বঞ্চিত করবো কেন? পরে অবশ্য বড়ভাই নিয়মিত এসেছেন, প্রয়োজনে আমাকে সাহায্যও করেছেন অনেক।
আমি সরাসরি মোসফেকা আপার সঙ্গে দেখা করে সেক্রেটারিয়েল ট্রেনিং ক্লাসে ভর্তি হতে চাইলাম। আমি বিএ পাশ শুনে তিনি অবাক হয়ে গেলেন। বললাম, প্রয়োজনে আমি আপনাকে সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজ থেকে সার্টিফিকেট এনে দেবো। উনি বললেন, শুধু বিএ রোল নাম্বার ও বছরটা দিয়ে দাও আমরাই সার্টিফিকেট নিয়ে নেবো। তুমি গেলে দেরি হবে। ভর্তি হয়ে গেলাম। বেইলী রোডে ক্লাস করতে আসতাম। আরও তিন-চারটি মেয়ে ছিল তারা সবাই মেট্রিক পাশ। দশমাস সময় কেটে গেল। কর্তৃপক্ষের সহায়তায় আমি একটি বাণিজ্যিক ব্যাংকে চাকুরি পেলাম। বেতন মোটামুটি মন্দ নয়। উন্নতির সুযোগ আছে। বেতন পাবার পর আপাকে ধরে আমি বেইলী রোডে কর্মজীবী মহিলা হোস্টেলে এলাম। আশ্চর্য! এখানে কোনও মেয়ে কোনও দিন বিন্দুমাত্র কৌতূহল দেখায় নি আমার অতীত নিয়ে। সবাই কর্মরত তবুও এর ভেতর আমরা গল্প গুজব করতাম, পাশের মহিলা সমিতিতে গিয়ে নাটকও দেখতাম। শাড়ি কিনতে যেতাম। ১৯৭৫ সালের ১৭ই মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে বত্রিশ নম্বর গিয়েছিলাম। সবার মাথায় হাত দিয়ে তিনি দোয়া করলেন। অবশ্য আমি নিজেই নিচু গলায় বলেছিলাম, বঙ্গবন্ধু আমরা বীরাঙ্গনা। আরে তাইতো তোরা আমার মা। আজও সেই কণ্ঠস্বর, সেই উন্নত মস্তিষ্ক, প্রশস্ত ললাট আর বুদ্ধিদীপ্ত চোখ যেন আমার অন্তরে চির ভাস্বর। হারিয়ে গেলেন আমার পিতা যিনি আমাকে দেবীর সম্মান দিয়েছিলেন। আজ মনে হয় এ মাটিতে দয়াদ্ৰহৃদয়, উদার চেতা, পরোপকারীর ঠাঁই নেই। স্বার্থান্ধের হাতে তার নিধন অনিবার্য।