সত্যিই একদিন সব চুপচাপ হয়ে গেল। আমাদের বাইরে ডাকা হলো। কোথায় নেবে? সেই জোরালো বাতিটা জ্বলে উঠলো। কে একজন বললো, বাহার আইয়ে মাইজী, মা আপনারা বাইরে আসুন। কি শুনছি আমি, আমাকে ‘মা’ সম্বোধন করছে। আর চারমাস আমি ছিলাম কুত্তী, হারামী, হারামজাদী, বন্যজীবের চেয়েও ইতর। হঠাৎ এভো আপায়ন। মানুষকে বিশ্বাস করতে ভুলে গেছি। ভাববার সময় নেই। হাত ধরে ধরে আমাদের কংকালসার দেহগুলোকে মনে হয় যেন টেনে বের করলো। কেউ চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো, কেউ বোকার মতো কেউ হিস্টিরিয়া রোগীর মতো হেসেই চলেছে। আমাদের সবাইকে একটা ঘরে নিয়ে মুখ হাত ধুয়ে কাপড় বদলাতে বলা হলো। আমরা এতোদিনে সেপাইদের মতো হুকুম মানতে বাধ্য হয়ে গেছি। আচরণ করেছি পোষা কুকুরের মতো, এরপর খেতে দেওয়া হলো রুটি মাখন কলা। যন্ত্রের মতো কম বেশি সবাই খেলাম তারপর পাশেই একটা অফিস ঘরের মতো জায়গায় নিয়ে একে একে আমাদের নাম ঠিকানা নিলো। যাদের ঢাকায় ঠিকানা আছে তাদের ঢাকা ও গ্রামের দুটো ঠিকানাই নিলো। কেউ কেউ নিজের দায়িত্বে চলে গেল। আমরা ওখানেই রইলাম তিনচার দিন। যাদের বাবা নিতে এসেছেন তাদের ভেতর কয়েকজন বাবার সঙ্গে চলে গেল। মেরীকে নিয়ে গেলেন তেজগা থেকে আসা একজন সিস্টার। সিস্টার ঠিক মায়ের মতো মেরীকে জড়িয়ে ধরে সান্তুনা দিলেন। মেরীর সঙ্গে আমার আবারও কয়েকবার দেখা হয়েছে। ও হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে ওর নিজের পেশায় নিযুক্ত আছে। বিয়েও করেছে একজন ব্রাদারকে। স্বপ্ন দেখছিলাম, হঠাৎ একজন বাঙালি অফিসার আমাকে জিজ্ঞেস করলেন আমি কোথায় যেতে চাই। আমি মাস দু’য়েকের অন্তঃসত্ত্বা। বললাম, আমাদের মতো মেয়েদের জন্য আপনারা কি কোনো আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থা করেছেন? নিশ্চয়ই, আপনি সেখানে যেতে চান? ঘাড় নাড়লাম। এই দেয়ালের বাইরে যেতে চাই আমি। এতো মূল্য দিয়ে কেনা স্বাধীন বাংলার বাতাস বুক ভরে নিয়ে দেখতে চাই, কেমন লাগে। ধানমন্ডি এলাম, ওখানে ডাক্তার নার্স সবাই আছেন। আমাকে দেখে বললেন, তুমি গর্ভবতী, আমরা গর্ভপাত করাবো। তোমার সম্মতি আছে। উত্তেজিত হয়ে বললাম, ডাক্তার সাহেব এখনই করুন। সস্নেহে মাথায় হাত দিয়ে বললেন, তোমাকে কয়েকটা দিন অপেক্ষা করতে হবে। তুমি খুব দুর্বল, একটু খাওয়া দাওয়া করে বিশ্রাম নাও। ঠিক হয়ে যাবে। বললাম, ডাক্তার বাড়িতে আমার ফাল্গুনী নামে মেয়ে আছে, আমাকে দয়া করুন। তোমার মেয়ে আছে, আচ্ছা দেখি। তারপর এক সিস্টারকে ডেকে বললেন, সিস্টার মাথার চুল কেটে ভালো করে স্যাম্পু করে দিন। এতো বড় চুল কিন্তু এটা তো জট পাকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে। সম্ভবত মাথায় ঘাও হয়ে গেছে। একটু যত্ন করে ওর ব্যবস্থা করে দিন। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হলাম। কাটা চুলের দিকে তাকিয়ে হাসলাম। সত্যিই আমার বড় বড় চুল ছিল। একদিন হাসনাত জিদ ধরলো আমাকে খোঁপা বেঁধে দেবে। চিরুনি ব্রাশ আর আমার চুলের সঙ্গে যুদ্ধ করে এক গোছা চুল ছিঁড়ে তবে থামলো। ওঃ ভাবতেও মাথাটা টন টন করে উঠলো। এই ববকাটা মেমসাহেবী মাথা দেখে কি ও রাগ করবে, না ঠাট্টা করবে। নিজের মনেই একটু হাসলাম। দশদিন পর আমার গর্ভপাত করানো হলো। তিনমাস হয়েছিল। আল্লাহ্ আর একমাস দেরি হলেই তো ওবা বুঝতে পারতো আর আমাকে বাইরে নিয়ে কি করতো? অস্কুট চিৎকারে মুখ ঢাকলাম। সিস্টার দৌড়ে এলেন কি হয়েছে? চোখের পানি মুছে বললাম, কিছু না। এরপর সাতদিন বিশ্রাম নিয়ে পথে পা দিলাম! টাকা চাইতেই পেলাম। ওরা বলে দিলেন বাসা খুঁজে না পেলে যেন ফিরে আসি, ওরা ব্যবস্থা করে দেবেন। বাসার সামনেই রিকশা থেকে নামলাম। কেউ তাকিয়ে দেখলো না। দরজার কড়া নাড়লাম। আম্মা দরজা খুলে দিয়ে এক মুহূর্ত আমার মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। তারপর দু’হাতে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পর জিজ্ঞেস করলাম, ফাল্গুনী? আমি তো জানি না ও বেঁচে আছে কিনা, কার কাছে আছে? মা বললেন, ও ভালো আছে চাচার সঙ্গে বেড়াতে গেছে। মা চা আর মুড়ি খেতে দিলেন। বহুদিন পর তৃপ্তির সঙ্গে খেলাম। বললেন, যাও তোমার ঘরে যাও, গোসল করে কাপড় চোপড় বের করে পরে নাও। মাথার দিকে তাকাতেই বললাম, খুব অসুখ করেছিল আম্মা, হাসপাতালে মাথায় পানি দেওয়ার জন্য চুল কেটে দিয়েছে। আহা, কি হাল হয়েছে আমার মায়ের। আম্মা আমার বাবা-মা তো সবাই ভালো আছে? ওরা তো আর গ্রাম থেকে ফিরে আসেন নি। তোমার মা তো ভাত-পানি ছেড়েছেন তোমার জন্য। ছোট খোকা এলেই ওদের খবর পাঠিয়ে দেবো। ফাল্গুনীকে নিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার বাপ দিলো না। মিনার মনে হয় একবার ছুটে যায়। তাদের ঐ ছোট বাড়িটায় যেখানে হাসি আনন্দ ছাড়া দুঃখ সে কখনও দেখে নি, আজ তার জন্য মা মরতে বসেছে। মা’তো জানে না তার মেয়ে কতোবার মরেছে আর কেমন লাশ হয়ে ফিরে এসেছে।
অনেকক্ষণ ধরে গোসল করলো মিনা। নিজের পছন্দ মতো শাড়ি, ব্লাউজ পরে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হয়ে বসেছে এমন সময় ফাল্গুনী এলো চাচার সঙ্গে। প্রথমে সে মাকে চিনতে পারে নি। কোলে যাবে না। কান্না জুড়ে দিলো। তারপর বোধাদয় হলো। ফাল্গনীকে বুকে জড়িয়ে ধরে ভাবলাম আল্লাহ্ ওর জন্যেই তুমি আমাকে ফিরিয়ে এনেছো। লক্ষ শোকর তোমার কাছে। বহুদিন পর একসঙ্গে ভাত খেলাম সবাই। আম্মা, কাল থেকে আবার আমি রাধবো, কতো কষ্ট গেছে আপনার। মাগো এ কষ্টের জন্য শরীর ভাঙেনি, দিনরাত তোমার কথা ভাবতে ভাবতে একেক সময় মনে হতো আমি কি পাগল হয়ে যাবো। যখন তিনমাস পার হয়ে গেল, তখন বুঝলাম তুমি আর নেই। যে দিন দেশ স্বাধীন হলো সেদিনও বারান্দায় দাঁড়িয়ে পথের দিকে চেয়েছিলাম। যদি তোমাকে বন্দি করে রেখে থাকে তাহলে অন্তত ফাল্গুনীর জন্যেও তুমি ছুটে আসবে। বুড়ো আম্মাকে ভুলে থাকলেও ওকে কি ভুলতে পারো? শাশুড়ি বউ দুজনেই গলাগলি হয়ে তিনমাসের জমাট বরফ গলিয়ে বুক হালকা করলাম। তখনও কি ছাই জানি এরপর বুকে বরফ যেন কাঞ্চনজঙ্গার মতো জমে থাকবে।