হয় পালিয়েছে। আপনি আম্মাকে নিয়ে দেশে যান। প্রয়োজন হলে আমরা পরে যাবো। তখন কি যাবার সুযোগ পাবে বাবা? না পেলে যাবো না। বাবা আর কথা বাড়ালেন না। হাতটা তুলে আমার শাশুড়িকে সালাম জানালেন। আমার মাথায় হাত বুলিয়ে হঠাৎ বাঁ হাত দিয়ে মুখ ঢেকে দৌড়ে বেরিয়ে গেলেন। বাবার অভিজ্ঞতায় বাবা বুঝেছিলেন সেই আমাদের শেষ দেখা। ওরা শহর রাখবে না। আর বাবা মার খবর পাই নি। মাসখানেক আমরা ওভাবেই রইলাম। আমার দেওর ও স্বামী ঘর থেকে বেরুতো না। ঘরে যা ছিল তার থেকে অল্প অল্প করে দিন চলে যাচ্ছিল।
দিনটা একভাবে কাটে। কিন্তু রাত হলেই গা ছম ছম করে। এক মাস পার হতেই প্রায় রোজই ফার্মগেটে গোলাগুলি হতো। আমরা থাকতাম ইন্দিরা রোডে, একটু ভেতরে, তাই সুস্পষ্ট কিছু বোঝা যেতো না। তবে মাঝে মাঝে মনে হতো গুলি দু’পক্ষের। ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসতো। সে-বার বৈশাখ-জৈষ্ঠ্য মাসে বৃষ্টিও হয়েছিল অসম্ভব রকম। সারারাত মনে হয় কান খাড়া করে বসে কাটাতাম। আস্তে আস্তে লোকজন চলাচল শুরু হলো। আমার স্বামীর অফিস থেকে তলব এলো। আমরা শাশুড়ি-বৌ অনেক নিষেধ করলাম। কিন্তু ও শুনলো না। পরদিন ফিরে এসে বললো, না অথারিটি ঢাকায় থাকতে দেবে না। এখানেই থাকতে হবে, ইচ্ছে করলে তোমরাও যেতে পারো। শাশুড়ি এবার বেঁকে বসলেন। উনি বিরক্ত হয়ে একাই চলে গেলেন। আমি শাশুড়ির ওপর অসন্তুষ্ট হলাম। মনে মনে ভাবলাম, ভদ্রমহিলা তার ছোট ছেলের নিরাপত্তার কথাই ভাবলেন। অনুদাতা বড় ছেলের দিকটা একটুও চিন্তা করলেন না। উনি মাসের প্রথম দিকে এসে মাইনের টাকা দিয়ে যান এবং একরাত থেকেই পরদিন গাজীপুর ফিরে যান। গোলাগুলির শব্দ এক রকম গা সওয়া হয়ে গেছে। এর ভেতর একদিন কি জানি কি হলো। বাড়ি ঘরের দরজা ভেঙে অল্পবয়সী ছেলেদের ধরে নিয়ে গেল। এবার ভয় পেলাম। এর ভেতর আজ দু’তিন দিন ফাল্গুনীর খুব জ্বর। ডাক্তার ডাকতে পারছি না। বেরুতেই ভয় করে। কিন্তু সেদিন দুপুরের পর সে হঠাৎ ফিট হয়ে গেল। এখনও তার বয়স দু’বছর হয় নি। আমি পাগলের মতো দৌড়ে বেরিয়ে একটা রিকশা নিয়ে কাছেই বড় রাস্তার উপর একটা ডিসপেনসারিতে ঢুকলাম। কপাল ভালো ডাক্তার ছিলেন। সিস্টার ওকে তুলে নিয়ে পাশের ঘরে ঢুকলো। ঠিক এই সময়ে হঠাৎ রাস্তায় গোলাগুলির শব্দ হলো। দু’তিনটা জিপ এসে থামলো। ডাক্তার রোগী দেখছে দেখে হঠাৎ আমার হাত ধরে টান দিলো। আমি চিৎকার করে উঠলাম। ডাক্তার কিছু বলবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু ততোক্ষণে দু’তিন জনে কিল, লাথি, থাপ্পড় দিয়ে আমার চুল ধরে আমাকে জিপে নিয়ে তুললো। ‘তিন দিন অচৈতন্য পড়ে রইলাম। জ্ঞান এলে ভাবি আমার ফাল্গুনী কি বেঁচে আছে। যদি মার্চ মাসে বাবার সঙ্গে চলে যেতাম তাহলে তো এমন হতো না। শুধু হাসনাতের গোয়ার্তুমির জন্য আমাদের মা মেয়ের প্রাণ গেল।
শুরু হলো অত্যাচারের পালা। শকুন যেমন করে মৃত পশুকে ঠুকরে ঠুকরে খায় তেমনি, কিবা রাত্রি কিবা দিন আমরা ওই অন্ধকার দোজখে পচতে লাগলাম। মাঝে মাঝে তারা ওপরে ডাকতো আমাদের। আমরা গোসল করতাম, কাপড় বদলাতাম তারপর আবার অন্ধকূপে। কারা আমাদের উপর অত্যাচার করতো, তারা বাঙালি না বিহারি, পাঞ্জাবি না পাঠান কিছুই বলতে পারবো না। ব্যাধিগ্রস্ত হলে তাকে নিয়ে যেতো। ভাবতাম যখন রোগে ধরবে অন্তত সেই সময়ে তো বাইরে যেতে পারবো, হাসপাতালে নেবে। পরে জেনেছি, হাসপাতালে নয় চিরকালের জন্য আলো হাওয়া দেখিয়ে দিতো। অর্থাৎ নির্বিচারে হত্যা করতো। মুক্তির পর অনেক মেয়ের মৃতদেহ পাওয়া গেছে যাদের পেট চেরা, চোখ তোলা ইত্যাদি অবস্থায়। বুঝতে পারছেন কি অত্যাচার গেছে সেখানে। আমি এসেছি আগস্টে অর্থাৎ অনেকের তুলনায় অনেক দেরিতে। ফিস ফিস করে কথা বলতাম, বিভীষিকাময় কাহিনী শুনতাম। একমাত্র বাইরের ব্যক্তি আসতো জমাদারণী। সে কিছু সত্য কিছু কাল্পনিক কাহিনী শুনিয়ে যেতো। নানা রকম উপদেশ দিতে যাতে সহজে বাচ্চা না আসে। কারণ যদি বাচ্চা পেটে আসে আর ওরা যদি জানতে পারে তাহলে তো অমন করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে খেলতে খেলতে মেরে ফেলবে। আস্তে আস্তে অন্ধকার চোখে সয়ে গেল। আবছা আলোতেও অন্যকে দেখতে পেতাম, চিনতে পারতাম। মেরী নামের একটি ক্রিশ্চিয়ান মেয়ের সঙ্গে এর ভেতরেই আমার একটু ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেল। ও কলাকোপ বান্দুরার মেয়ে। চন্দ্রঘোনা হাসপাতালে নার্স ছিল। খাবার দেবার সময় হঠাৎ করে একটা জোরালে বাতি জ্বালাতো ফলে সবাই দু’হাতে চোখ ঢাকতাম, অনেকক্ষণ কিছু দেখতে পেতাম না। চোখের সামনে নীল নীল গোল বলের মতো ঘুরে বেড়াতো। বুঝতাম বেশিদিন এভাবে থাকলে অন্ধ হয়ে যাবো। কেনই-বা আমাদের এভাবে রেখেছে? পরে জেনেছিলাম বিভিন্ন দূতাবাসের প্রতিনিধিদের এনে দেখাতে মেয়েদের ওপর অত্যাচার মিথ্যা কথা, কারণ ছাউনিতে কোনো মেয়েই নেই। অথচ আমরা অসংখ্য মেয়ে তখন ভূ-গর্ভের বাংকারে মৃত্যুর অপেক্ষা করছি।
হঠাৎ করে গোলাগুলির আওয়াজ বেড়ে গেল। জমাদারণী বললো, সারাদেশে যুদ্ধ হচ্ছে আর পাকিস্তানিরা হেরে গিয়ে ঢাকায় এসে জমা হচ্ছে। ঢাকা শহরেও মুক্তিবাহিনী ঢুকে গেছে। ততোদিনে মুক্তিবাহিনীর নাম ও তার সংজ্ঞা আমার জানা হয়ে গেছে। বিশ্বাস হতো না, এতো কামান বন্দুকের সঙ্গে বাংলাদেশের খর্বাকার, কৃশ, অনাহারক্লিষ্ট যুবকেরা যুদ্ধ করছে। আর কি হচ্ছে তাতো জানি না। হঠাৎ বোমা পড়তে শুরু করলো। সে কি শব্দ! মাটি কেঁপে কেঁপে উঠলো। ভাবলাম সবাই মিলে মাটি চাপা পড়ে এখানেই মরে থাকবো। কোন দিন কোন সময়ে আমাদের কঙ্কালগুলো আবিষ্কার হবে। পাঁচ দিনের ভেতর সব শব্দ বন্ধ হয়ে গেল। দিন-রাত শুধু গাড়ির শব্দ আর ওপরে লোকজনের আনাগোনা। আস্তে আস্তে শব্দ, চলাফেরা সবই কেমন যেন স্তিমিত হয়ে উঠলো। আমাদের দিন-রাতের অতিথিরা অনুপস্থিত। মেয়ে মানুষের রুচি অন্তর্হিত হয়েছে। এখন সম্ভবত জান বাঁচাবার চিন্তা। জমাদারণী বললো, পাকিস্তানিরা সারেন্ডার করবে। কিন্তু আমাদের? আমাদের কি হবে? বেঁচে গেলে আর কি! কেন আমাদের মেরে ফেললো না? আর মারা হবে না। যদি মুক্তি এসে দেখে তোমাদের মেরে ফেলেছে তাহলে তো ওদের কচু কটা করবে। একটু ধৈর্য ধরো। সবাই বেরুতে পারবে।