একেবারে প্রথম জীবনে উচ্ছলতা নিয়ে ফিরে এলো ফাতেমা। শ্বশুর-শাশুড়ি আনন্দে আত্মহারা। ফাতেমা মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদরে আদরে ভরে দিলো। কারণ ও মনে করতে পারে না চাপাকে কখনও কোলে নিয়েছে কিনা। গাল ফুলিয়ে খোকন দাঁড়িয়ে আছে দাদির হাত ধরে। কোলে নিতে গেলে ছোট দুটো হাত দিয়ে ঠেলে দিলো। সবাই হেসে উঠলো। খোকন লজ্জায় দাদির শাড়িতে মুখ লুকালো।
অনেক দিন আগের কথা, তেইশ বছর পার হয়ে গেছে। ১৯৭৩ সালে আমি খুলনা গেছি। দৌলতপুর কলেজে আমার কয়েকজন ছাত্র ছিল। ইচ্ছা ওদের একটু খোঁজ খবর নেয়া, কে কেমন আছে, দেশের খবর নেয়া ইত্যাদি। দেখলাম এক মহিলা কলেজে ঘুরে বেড়াচ্ছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি চাও তুমি? রক্তচোখ মেলে বললো, কলেজে পড়বো। বুঝলাম মেয়েটি স্বাভাবিক নয়। বললাম, তোমার নাম কি? নাম? ফতি পাগলী, হয়েছে। এবার যান। একজন ছাত্রকে জিজ্ঞেস করায় বললো, উনি একজন বীরাঙ্গনা। উনি অসুস্থ, প্রায়ই আসেন। ঘুরে ঘুরে চলে যান। বাড়ি কাছেই, সোনাডাঙা। আমার সঙ্গে গাড়ি ছিলো। অনেক বুঝিয়ে ওকে নিয়ে গেলাম ওদের বাড়িতে, ওই পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল। ওর বাবা-মা ও দু’ভাইয়ের সঙ্গে দেখা হলো। কাহিনী শুনলাম। বললাম ঢাকা পূণর্বাসন কেন্দ্রে পাঠিয়ে দেন। আমরা চিকিৎসা করাবো। ওরা শুনলেন কিন্তু তাৎক্ষণিক কোনও জবাব দিলেন না, ওদের ঠিকানা নিলাম। ওর ভাই দু’বার ঢাকায় এসে ওর খবর আমাকে দিয়ে গেছে। তারপর চাপা এসেছে, যোগাযোগ করেছে। ওর বিয়েতেও গিয়েছিলাম। এই হচ্ছে আমার বিবি ফাতেমার সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র।
আমি যে ক’জন বীরাঙ্গনার সাক্ষাৎ পেয়েছি তাদের মধ্যে সর্বাধিক নির্যাতিত এই ফাতেমা। হয়তো তার নামের রক্ষাকবচ তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। আজ তাহের একজন প্রতিষ্ঠিত ধনী ব্যবসায়ী। ফাতেমার মেয়ে চাপা আইএসসি পড়ে। সে তার খালাম্মা অর্থাৎ চাপার মতো ডাক্তার হবে। খোকন হতে চায় সাংবাদিক। ফাতেমা অনেক সমাজ কল্যাণমূলক কাজ করে। সে আজ সত্যিই মহিয়সী গরিয়সী ফাতেমা, আর বঙ্গবন্ধুর মানসকাম্য বাংলার বীরাঙ্গনা।
৭. মিনা
০৭.
এ পাড়ার অনেকেই আমাকে চিনতো, চিনতো বললাম এ জন্যে যে, সে আজ বাইশ বছর আগেকার কথা। ‘৬৮ সালে বিয়ের পর আমি এ পাড়া থেকে চলে যাই। মৌচাক মার্কেট থেকে সোজা রামপুরা টিভি ভবনের দিকে মুখ করে সাত আট মিনিট হাঁটলেই দেখবেন হাতের দু’পাশে পর পর বেশ কয়েকটা গলি। ওরই একটাতে আমরা থাকতাম। তখন মিনা বললে ওকে এলাকার সবাই চিনতো। তখন তো ঢাকায় এমন মানুষের মাথা মানুষ খেতো না। ফাঁকা ফাঁকা বাড়িঘর। আমাদের পৈত্রিক বাড়ি নোয়াখালি। হাসছেন কিনা জানি না ছোটবেলা থেকেই দেশের নামটা বললে মানুষ নানা রকম মুখভঙ্গী করে। মা ফরিদপুরের মেয়ে। ওরা দুজন কেমন করে যে এতোটা পথ অতিক্রম করে এক সূত্রে বাঁধা পড়লেন তারও ইতিহাস আছে। দাদু আর নানা দুজনেই ঢাকায় কালেকটারিয়েটে চাকুরি করতেন। থাকতেন অল্প ভাড়ায় শহর থেকে দূরে, এখানে ছোট একতলা বাড়িতে। তাদের ঘনিষ্ঠতা অতি সহজে আমার বাবা মাকে এক করেছিল। আমরা দুই বোন এক ভাই। ভাই বড়, ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে তখন কমার্স নিয়ে পড়ে, আমি মেজো, বিয়ের সময় সেন্ট্রাল উইমেন্স কলেজে বিএ পড়ি। বেশ ধুম ধাম করেই সাধ্যাতীত খরচ করে বাবা প্রথম মেয়ের বিয়ে দিলেন। স্বামী হাসনাত তখন অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরীতে চাকুরি করতেন। খুব তুচ্ছ চাকুরি নয়। আমাদের সংসার চারজনের মোটামুটি ভালোই চলে যেতো। সত্তর সালে আমার প্রথম মেয়ে ফাল্গুনীর জন্ম হয়। পরিবারের প্রথম সন্তান। আনন্দের জোয়ার বয়ে গেল সবার জীবনে। বাবা একেক দিন অফিস ফেরত সেই সদরঘাট থেকে ফার্মগেট চলে আসতেন। নাতনিকে আদর সোহাগ করে চলে যেতেন। আমার শাশুড়ি খুব খুশি, রোজ রোজ বেয়াইয়ের দেখা পাচ্ছেন। আমার শ্বশুর মারা গেছেন প্রায় বছর দশেক আগে। বাচচা থাকতো তার দাদির কাছে। আমাদের সিনেমা থিয়েটার বেড়ানো কোনোটারই কমতি ছিল না। কিন্তু ধীরে ধীরে জাতির ভাগ্যাকাশে কালো মেঘ ঘনিয়ে এলো। গণ-অভ্যুত্থান বিস্ফোরনুখ আগ্নেয়গিরির আকার নিলো। তবুও বেশ একটা আনন্দে ছিলাম। দেশ স্বাধীন হবে।
কিন্তু ২৫শে মার্চের রাতে সকল মজার সমাপ্তি ঘটলো। ২৬শে সবাই ঘরে বন্ধ। স্বামী ২৫শে মার্চ ঢাকায় আসেন নি। গাজীপুরে রয়ে গেছেন। ২৭শে মার্চ সকাল থেকে লোকের মুখে মুখে এমন সব খবর আসতে লাগলো যে ভয় হলো, ফাল্গুনীর আব্বা বেঁচে আছে তো? শাশুড়ি কেঁদে কেঁদে বিছানা নিলেন। বাবা-মার খবর নেই। কে যোগাযোগ করবে। তরুণ ছেলেকে পথে বের করলে মিলিটারী গুলি করে মারবে। ওঃ সে কি দোজখের যন্ত্রণা! তিনদিনের দিন হাসনাত ফিরে এলো। ফ্যাক্টরী আক্রান্ত। অনেকে মারা গেছে। আল্লাহর মেহেরবান যে ও ফিরে আসতে পেরেছে। আমার ফাল্গনীর কিসমতে ওর আব্বা বেঁচেছে। চারদিন পর আব্বা এলেন। বড় ভাইয়ের খবর পেয়েছেন লোক মারফত, সে এখন বাড়িতে আসবে না। এলেই বিপদ, তাই আব্বা মাকে আর মুন্নীকে নিয়ে দেশে চলে যাচ্ছেন। তিনি এসেছেন আমাদের নিতে। কিন্তু আমার শাশুড়ি ছেলেকে রেখে যেতে কিছুতেই রাজি হলেন না। দশ বছর আগে স্বামী হারিয়েছেন। এই ছেলে দুটি নিয়ে তার জীবন। বললেন, বেয়াই সাহেব, আপনি আমিনাকে আর ফারুনীকে নিয়ে যান। বাবা উত্তর দিলেন, ঠিক আছে। আপনি হাসনাতকে বলুন, আমি এখনই ওদের নিয়ে যাবো। কিন্তু আমার স্বামী কিছুতেই আমাদের যেতে দিলেন না। বাবার সঙ্গে অযৌক্তিক তর্ক করলেন। মিলিটারীরা নাকি তিনদিনে সব ঠাণ্ডা করে দিয়েছে। শেখ মুজিব বন্দি, তার সঙ্গী-সাথীরা হয় মরেছে