পরদিন হঠাৎ ওদের ভেতর একটি মেয়ে মারা যায়। অন্তঃসত্ত্বা ছিল। সকাল থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। ওরা বন্ধ দরজায় অনেক চেঁচামেচি করলো। কিন্তু কেউই এগিয়ে এলো না। ব্যাপারটা বোঝা গেল না। মেয়েটার নাম ছিল ময়না। বছর পনেরো বয়স হবে। কাটা পাঁঠার মতো হাত-পা ছুঁড়ে আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়লো, মুখখানা নীল হয়ে গেলো। বয়স্কা সুফিয়ার মা একটা ছোট কম্বল দিয়ে ঢেকে দিলো কারণ ও ঘরে ওরা চাদর দেয় না। সন্ধের পর ওরা লাশটা নিয়ে গেল। আমাদের ভেতর এক অস্বস্তিকর নিস্তব্ধতা নেমে এলো। এমন কি পশুগুলোরও নারীর প্রয়োজন ফুরিয়েছে মনে হচ্ছে। তাহলে এবার হয়তো আমাদের মেরে ফেলতে পারে। তারা বুকের ভেতর কেমন যেন একটা অস্থিরতা অনুভব করলো। এতো যন্ত্রণায় এরা সবাই রয়েছে –আর পারি না। আল্লাহ্ আমাদের তুলে নাও, ভগবান মুক্তি দাও, কিন্তু তারা কখনও মৃত্যু কামনা করে নি, শুধু বেঁচে থাকার জন্য প্রার্থনা জানিয়েছে।
গোলাগুলির শব্দ ক্রমশ কমে আসছিল। বেশ শীত পড়েছে। ছোট্ট কম্বলের টুকরোটা গায়ে দিয়ে জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকি। তারপর একদিন ভোররাতে সব কেমন নিঃশব্দ, নিস্তব্ধ মনে হলো। সুফিয়ার মা বললো, হালারা পালাইলো নাকি? ওর কথায় যেন শরীরে অসুরের বল পেলাম। দরজা ধাক্কাতে লাগলাম। চেঁচাতে আরম্ভ করলাম। হঠাৎ শুনি ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’। যে সুফিয়ার মায়ের সঙ্গে কখনও কথা বলি নি আজ মায়ের মতো ওকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলাম। সাতাশে মার্চের পর আর কখনও কেঁদেছি কি? মনে হয় না। হঠাৎ করে আমাদের দরজা খুলে গেল। আমরা ভয়ে ঘরে ঢুকে পড়লাম। লোক যে ক’জন এসেছে তাদের ভদ্ৰশ্রেণীর মনে হলো না। সুফিয়ার মা ওদের সঙ্গে এগিয়ে গিয়ে কথা বললো। ওরা বললো ওরা মুক্তি। কিন্তু ওদের চাহ নি দেখে বিশ্বাস হলো না। ঠিক এমনি সময় একটি জিপের শব্দ পেলাম, কারা যেন খুব উচ্চ স্বরে ‘জয় বাংলা’ বলে উঠলো। আমরাও স্বতঃস্ফূর্তভাবে চিৎকার করে উঠলাম, ‘জয় বাংলা’। জিপ থেকে নেমে এলো খাকি কাপড় অর্থাৎ ইউনিফর্ম পরা তিনজন আর লুঙ্গি, গেঞ্জি, প্যান্ট পরা স্টেনগান হাতে সাত আটজন। ওদের নেতা এগিয়ে এলো। আমি একেবারে অন্ধকার কোণে গিয়ে ঢুকলাম। সেই সাতাশে মার্চের দৃশ্যটা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। ইউনিফর্ম পরা একজন বুঝলো আমি ভয় পেয়েছি। আমার কাছে এগিয়ে এসে কোমল কণ্ঠে বললো, আইয়ে… আমার কি হলো জানি না। প্রচণ্ড একটা তীব্র তীক্ষ্ণ চিৎকার করে মাটিতে পড়ে গেলাম। পরে শুনেছি ওরা মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। কাছের গ্রাম থেকে কাপড় জামা এনে বাকিদের পরিয়ে নিয়ে গেছে। আমি অচৈতন্য থাকায় সরাসরি নিকটবর্তী হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে গেছে।
জ্ঞান হলে দেখলাম একটা ছোট্ট হাসপাতাল। তবে ওখানকার লোকজনদের কথায় বুঝলাম উত্তরবঙ্গেই আছি। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, এটা কোন্ জায়গা? মনে হলো শুনলাম ঈশ্বরদী। অকথ্য অত্যাচার আর যন্ত্রণাকে আঁকড়ে থাকার ফলে আমার বোধহয় কিছুটা মাথায় গোলমাল হয়েছিল। এরপর বলছিলাম-বাবার কাছে যাবো, বাবার কাছে যাবো। কিন্তু যখন বাবার নাম জিজ্ঞেস করলো তখন কিছুতেই বাবার নাম বলতে পারলাম না। শুধু ভেউ ভেউ করে কাঁদলাম। ফলে আমার লাভ হলো আমাকে সরাসরি ঢাকায় নিয়ে এলো সম্ভবত আমি হেলিকপ্টারে এসেছিলাম, কাণ প্লেনে খুব শব্দ হচ্ছিল। ওখানেই আমার জ্ঞান ফিরে আসে। বুঝলাম, আমি মেডিক্যাল কলেজের মহিলা ওয়ার্ডে এসেছি। তাকিয়ে তাকিয়ে চারদিকে দেখছিলাম, মনে হলো এতো লোক আমি কখনো দেখি নি। তখন ঠিক কটা বলতে পারবো না, তবে দুপুরের খাবার দিয়ে যাচ্ছিল। আমাকেও দিলো। একজন সিস্টার সাহায্য করলেন। মুখ ধুয়ে ভাতের থালা টেনে নিলাম। ঝরঝর করে আমার দু’গাল বেয়ে নামা চোখের জলে ভাত ভিজে উঠলো। সিস্টার পিঠে হাত বুলিয়ে হাতে ধরে খেতে বললেন। সত্যিই কি সর্বগ্রাসী ক্ষুধা আমাকে পেয়ে বসলো জানি না। ওই ভাত তরকারি অমৃত জ্ঞানে খেলাম। মনে হলো আমি বেঁচে গেছি। কিন্তু জানতাম না তখনও যে কত মরণ আমার জন্যে অপেক্ষা করে আছে। তিন-চারদিন ওখানে থাকার পর একজন ডাক্তার আমাকে জানালেন আমি গর্ভবতী। আমি কোথায় কার কাছে যেতে চাই? ঠোঁট চেপে বললাম, কারও কাছে নয়, আমার মতো দুস্থ মেয়েদের জন্য আপনারা যে ব্যবস্থা করবেন আমার জন্যেও তাই করুন। আপনার আত্মীয় স্বজন কেউ নেই? জিজ্ঞেস করলেন মমতাময়ী চিকিৎসক। না সূচক মাথা নাড়লাম। তিনিও বুঝলেন।
প্রায় মাসখানেক পর আমি ধানমন্ডি পুনর্বাসনকেন্দ্রে এলাম, যেখানে বহুবার আপনার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছে। মেডিক্যাল কলেজে থাকতে বেশ কৌতূহলী নারী-পুরুষের ভীড় হতো আমার সামনে। জিজ্ঞেস করে জানলাম-ওরা বীরাঙ্গনা দেখতে আসে। সিস্টার সবিস্তারে ব্যাপারটা আমার কাছে ব্যাখ্যা করলেন। প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন যেসব রমণী মাতৃভূমির জন্য তাদের সতীত্ব, নারীত্ব হারিয়েছে তিনি তাদের বীরাঙ্গনা আখ্যায় ভূষিত করেছেন। অন্তরের শ্রদ্ধা জানালাম সেই মহানায়কের উদ্দেশে। আমি বীরাঙ্গনা, এতোবড় সম্মান আমি পেয়েছি। আমি ধন্য কিন্তু চোখের জল কেন জানি না বাধা মানে না। বাবাকে দেখবার জন্য, তাদের খবর নেবার জন্য অস্থির হয়ে গেছি। কিন্তু বিশ্বাসযোগ্য এমন কাউকে দেখি না যাকে অনুরোধ করা যায়। শেষে পুনর্বাসন কেন্দ্রের কার্যনির্বাহী অফিসার মোসফেকা মাহমুদকে বাবার ঠিকানা দিলাম। পথের দিকে তাকিয়ে থাকি, যেন খবর পেয়েই বাবা ছুটে আসবেন। কিন্তু না দিন গড়িয়ে সপ্তাহ গেল। খবর পেলাম বাড়িঘর ভেঙে গেছে সেসব মেরামত করা নিয়ে বাবা ব্যস্ত, আসবেন কয়েক দিনের মধ্যে। শুধু উচ্চারণ করলাম, ‘বাবা তুমিও’। এখন বাইরের লোক দেখলেই সরে যাই। শেষপর্যন্ত সেই যে পোলিশ লেডী ডাক্তার ছিলেন তাকে ধরলাম আমাকে কাজ শেখাবার জন্য। তিনি সানন্দে রাজি হলেন। সব চিন্তা বিসর্জন দিয়ে কাজে লাগলাম।