ছেলে হয় ফাতেমার। একেবারে তাহেরের মুখ। সবাই খুব খুশি। ফাতেমাও খুশি, কিন্তু মাসখানেকের ভেতর আবার সেই মাথার যন্ত্রণাটা বাড়লো। সারারাত বসে থাকে, ঘুমায় না। তাহেরকে বলে, চুপ, শোনো, ওই যে বুটের শব্দ। ট্রাকের শব্দ পাচ্ছোনা ওঃ বাবা আমার মাথা ছিঁড়ে গেল আমায় ছেড়ে দাও। তাহের বুঝতে পারে কি অমানুষিক অত্যাচারের ভেতর দিয়ে ওর দিন কাটছে। এক এক সময় ওকে বুকে নিয়ে তাহের কাঁদে, ভাবে কি করবে ওকে নিয়ে। একদিন বাড়ির কাজের ছেলেটা হাঁপাতে হাঁপাতে দোকানে এসে হাজির। ভাবি বাড়িতে নেই, কাউকে কিছু না বলে কোথায় চলে গেছে। দাদি আম্মা কাঁদছে। তাহের ছুটে বেরিয়ে গেল। ওর বাপের বাড়িতেই আগে গেল। ওরা বললো, কয়েকদিন আগে একব্বার এসেছিল কিন্তু আজ তো আসে নি। তাহেরের মাথায় বজ্রপাত হলো। আল্লাহ এ তুমি আমার জীবনে কি অঘটন ঘটালে। ফাতেমার মতো একটা সহজ সরল, নিষ্পাপ মেয়ের ভাগ্য এমনিই বিড়ম্বনায় ভরে যাবে? তাহের আর দেরি না করে বিহারী কলোনীর দিকে ছুটলো তার হুণ্ডা নিয়ে। রাস্তায় মনার এক বন্ধু হাত উঁচু করে তাকে থামিয়ে বললো, বুবু বিহারী। কলোনীর দিকে গেছে। আমি অনেক সাধলাম। তাহের ছুটে গিয়ে দেখলো খুব ধীরে ধীরে হেঁটে চলেছে ফাতেমা আর নিজের মনে বিড় বিড় করছে। তাহের ওর সামনে গিয়ে গাড়ি থামিয়ে আস্তে ওর কাঁধে হাত দিতেই ও চমকে উঠলো, তারপর তাহেরকে জড়িয়ে ধরে হাত জোড় করে কেঁদে উঠলো, তুমি তুমি এসেছো? এই যে এইখানে, আমার ছোট ভাই পোনাকে নাসির আলি আছড়ে মেরেছিল। জানি, আমি সবজানি, ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললো তাহের। ফাতেমা বাড়ি চলো। বাচ্চারা কাঁদছে। অতি সহজে সে তাহেরের হোল্ডার পেছনে উঠে বসলো এবং স্বাভাবিক ভাবেই বাড়িতে এলো। যেন কিছুই হয় নি। শাশুড়িকে দেখে ছুটে এসে তার গলা জড়িয়ে ধরে বললো, আম্মাগো, আমার বড় কষ্ট গো আম্মা। জানিরে মা, আমি সব জানি। আমার বুকে আয়, তোর মন শান্ত হবে। তাহের, ওর আব্বা কারও চোখই আর শুকনো ছিল না। বাচ্চা দুটোও কাঁদতে শুরু করেছে। এবার তাহের মরিয়া হলো ওর চিকিৎসার জন্য। চাপা লিখেছে ও ফাতেমাকে নিয়ে কলকাতা যাবে। ডাক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছে। তাহের যেন ফাতেমার পাসপোর্ট নিয়ে ঢাকায় আসে। সম্ভব হলে যেন হাজার কুড়ির মতো টাকার যোগাড় করে, আর সম্ভব না হলে যেভাবেই হোক চাপা টাকার যোগাড় করবে।
তাহেরের অবস্থা বেশ ভালো। জমির আয় ছাড়া এখন ও ধান চালের ব্যবসাও করে। নির্দিষ্ট সময় তাহের ফাতেমাকে নিয়ে ঢাকায় গেল। তবে যাবার সময় চাপা আর খোকনের জন্য বেশ মন খারাপ করলো। শাশুড়িকে বার বার সাবধানে থাকতে বললো, শ্বশুরের পা ধরে সালাম করে ওর বুকে মুখ রেখে কেঁদে বললো, আব্বা আমার জন্য দোয়া করবেন। যেন ভালো হয়ে ফিরে এসে আপনার ও আম্মার সেবা করতে পারি। শ্বশুর তো শিশুর মতো হাউ মাউ করে কাঁদলেন। তাহেরের হাতে হাত ধরে বললেন, বাপ, আমার মায়ের অযত্ন করিস না। চাপা সব ব্যবস্থা করে রেখেছে। ভিসা নিতে একদিন সময় লাগলো।
যে ডাক্তারের কাছে চাঁপা ফাতেমাকে নিয়ে গেল তিনি চাপার বাবার খুব অনুগত রাজনৈতিক কর্মী ছিলেন। সুতরাং ফাতেমার যত্নের অভাব হলো না। সব দেখে শুনে তিনি বললেন, ওর মাথায় একটা অপারেশন করতে হবে। আশা করি ও সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে যাবে। যে কথা তাহের জানে না সেই কথাই চাঁপা ডাক্তারকে বললো। সে নির্মম কাহিনী বর্ণনা করতে গিয়ে সে নিজেও কেঁদে উঠলো। ডাক্তার নিচু হয়ে চাপাকে প্রণাম করলো। দিদি, আপনারা প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। আশ্চর্য এতো ত্যাগ স্বীকার করে দেশ স্বাধীন করলো বাঙালিরা, আর মা-বোনের দেয়া ত্যাগের মূল্য দিতে পারলো না। দুর্ভাগ্য সে দেশের!
ঠিক মতো অপারেশন হলো। সব সুদ্ধ দশদিন থাকতে হলো ডাক্তারের ক্লিনিকে। ঔষধ পত্রের দাম ছাড়া ডাক্তার একটি পয়সাও নিলেন না। তাহের বোকা বনে গেল। তাহের চাপাকে বললো, দিদি, আপনি একটা ব্যবস্থা করুন। চাপা পাঁচ হাজার টাকা ডাক্তার চৌধুরীকে দিয়ে বললো, টাকা জমা রাখেন ডাক্তার সাহেব। আমাদের মতো কোনও হতভাগিনীর যদি প্রয়োজন পড়ে তাহলে খরচ করবেন। আর ডাক্তারের বউকে একটা দামি শাড়ি, ফল, মিষ্টি, নিয়ে দু’জনে বাড়িতে দেখা করতে গেল। যে সম্মান তারা সেদিন করেছিল ফাতেমা তা কখনও ভুলবে না। ঢাকা ফিরে এলো। তাহের কলকাতা থেকে আব্বাকে ফোনে দুদিন পর পরই খবর জানিয়েছে। ঢাকা ফিরেই ফোন করে জানালো, ফাতেমা খুব ক্লান্ত। চাপার ওখানে দুদিন থেকে ফিরে আসবে। আল্লাহর রহমতে ওরা সবাই ভালো আছে। আসলে তাহেরের বড় ইচ্ছা চাপা আর ফাতেমাকে নিয়ে ঢাকায় একটু ঘোরাফেরা করে। ফাতেমা কলকাতা থেকেই চাপার জন্য শাড়ি, বাবলুর জন্য জামা কাপড় খেলনা, নিজের ছেলেমেয়ে, শ্বশুর-শাশুড়ি সবার জন্য প্রাণভরে জিনিসপত্র এনেছে। ঢাকায় খুব ঘুরে বেড়ালো। সাভার শহীদ স্মৃতিসৌধ দেখতে নিয়ে তাহেরকে বললো ফাতেমা, শহীদ হলে এখানেই তো থাকতাম। তাহের সহজ হেসে বললো, আমাকে পেতে কোথায়? ফাতেমা কৃতজ্ঞতায় চোখ নামিয়ে নেয়। মীরপুর গেল, রায়ের বাজার গেল শেষ পর্যন্ত সাহস সঞ্চয় করে চাপাকে নিয়ে বত্রিশ নম্বরে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি দেখতে। আশ্চর্য চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে বঙ্গবন্ধু ওপরে ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, ওর মাথার দিকে। হাসছেন, বললেন, আমি তোদের বীরাঙ্গনা বলে ডেকেছি। তোরা কি ব্যর্থ হতে পারিস। কখনোই না। আমার আশীর্বাদ রইলো তোদের ওপর। সেন্ট্রি ঢুকতে দিতে চায় না। ভেতর থেকে এক ভদ্রলোক বেরিয়ে এলেন সব শুনে ওদের নিয়ে ভেতরে গেলেন। সামনে বঙ্গবন্ধুর বিশাল প্রতিকৃতি। ওখানে সালাম করে ফাতেমা তাড়াতাড়ি বেরিয়ে এলো। পথে পা দিয়ে আফসোস করলো, খেয়াল নেই কিছু ফুল থাকলে ভালো হতো। অবশ্য আগে তো বুঝতে পারি নি যে ভেতরে যাবার সৌভাগ্য আমার হবে। আনন্দ উল্লাসের ভেতর দিয়ে ফিরে এলো ওরা। চাপাকে শুধু ফাতেমা বললো, তুই আমাকে জীবন দিলি, আমি তো তোকে কিছুই দিতে পারলাম না। চাঁপা ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, ফাতেমাদি, তুমি তো নিজেকেই আমায় দিয়ে দিয়েছে। আমি আর কি চাইবো বলো? তবে যখন মন চাইবে তোমার শান্তির সংসারে গিয়ে কয়টা দিন থেকে আসবো।