একটি সুন্দর ফুটফুটে মেয়ে হলো ফাতেমার। নাম রাখলো চাপা। খবর পেয়ে চাপা এলো দেখতে। কতো কিছু এনেছে ফাতেমার মেয়ের জন্য। ওর স্বামী ডঃ করিম আসতে পারেন নি, ছুটি পান নি। চাঁপার একটি ছেলে দু’বছর বয়স। শাশুড়ির কাছে রেখে এসেছে। ফাতেমা খুব রাগ করলো এমন ভাবে বাচ্চাকে ও দুলাভাইকে রেখে আসবার জন্য। মুখের আদল কিন্তু অনেকটা চাঁপার মতোই। ও পেটে থাকতে ফাতেমা দিন-রাত ঠাপাকেই ভেবেছে। এ নিয়ে দু’বন্ধুর কতো গল্প কতো হাসাহাসি। তাহের যত্নের ত্রুটি করে নি। দামি একটি শাড়িও এনে দিয়েছে ফাতেমার হাতে চাপাকে দেবার জন্যে। চাপা খুব খুশি হয়ে বললো, ভাই, আমার পিছুলে কেউ নেই। আপনি হইলেন আমার ভাই। না, চাপার ভায়েরা কোনও যোগাযোগ রাখতে রাজি হয় নি। তাই শেষ পর্যন্ত চাপা দেশের ছেলে ডঃ করিমকে বিয়ে করেছে। ভালোই করেছে, নইলে কোথায় ভেসে যেতো তার কি ঠিক ছিল। আজ যদি ফাতেমার বাবা-মা না থাকতেন তাহলে সোনা, মনা, কি তার জন্যে এতোটা করতো। কখনই না। বাপ-মায়ের কাছ থেকে যা পাওয়া যায় ভাইদের পক্ষ থেকে কি তা আশা করা যায়, না আশা করা উচিত? চলে গেল চাপা। ফাতেমার দিন আর কাটে না। চাপা তো তার শাশুড়ির কাছেই থাকে সর্বক্ষণ শুধু কাদলে ওর কাছে নিয়ে আসেন খিদে মেটাবার জন্য। ফাতেমা বিরক্ত হয় আবার ভাবে ও বৃদ্ধ মহিলা কি নিয়ে থাকবেন। পেয়েছেন একটা খেলনা, সারাদিন তাই নিয়ে খেলেন। ওকে তেল মাখান, কাজল পরান, গান গেয়ে ঘুম পাড়ান। উনি একটা পরিপূর্ণ জীবন পেয়েছেন। এবার ফাতেমা তাহেরকে ধরে বসলো শ্বশুরকে বলে তার আগের চাকুরিটা পাইয়ে দেবার জন্য! তাহের এই কথায় রাজি হলো না। বললো, তুমি এখন ঘরের গিন্নি। সংসার তোমার মাথায়। মা তো অষ্টপ্রহর চাপাকে নিয়েই আছেন, তুমি কেন নিজেকে সুখী ভাবতে পারো না ফাতেমা। আমি তো তোমাকে পেয়ে বেহেশতে বাস করছি। ফাতেমা বলে, তাহের তুমি দেখলে না চাপাকে? ইচ্ছে হলো হুট করে দেখতে এলো। আমি যেতে পারবো ওভাবে ওর ছেলেকে দেখতে? কেন পারবে না? আমি তোমাকে নিয়ে যাবো। তুমি আমাকে নিয়ে যাবে জানি কিন্তু আমি নিজের থেকে নিজের ইচ্ছায় কিছু করতে পারবো না কেন? জানো, চাপা নিজে উপার্জন করে, স্বাবলম্বী, তাই ইচ্ছেমতো চলাফেরাই শুধু নয় কাজ কর্মও করতে পারে। দেখো আমি যদি কাল মাকে দেখতে যেতে চাই তাহলে তোমার মায়ের অনুমতি নিতে হবে, কেন? কে বলেছে অনুমতি নিতে হবে ফাতেমা? এসব কি তোমার মাথায় ঢুকছে? মা কি কখনও কোনোদিন তোমাকে ও বাড়িতে যেতে বারণ করেছেন? ফাতেমা মুখ নিচু করে বসে থাকে। আজকাল তাহেরেরও সব সময় ফাতেমার এই অকারণ আপত্তি আর জিদ ভালো লাগে না। অথচ মা তাকে খুবই ভালোবাসেন, বৌ অন্ত প্রাণ। ফাতেমাও মাকে নিজের মায়ের চেয়ে কম ভালোবাসে না, তাহলে কেন এই জটিলতা?
ফাতেমা আজকাল প্রায়ই বলে ওর মাথায় একটা যন্ত্রণা হয়। ঝাঁকিয়ে কেঁদে কেটে অস্থির হয়ে যায়। মা বার বার বলছেন, তাহের বউকে ভালো ডাক্তার দেখা। ডাক্তার দেখানো হলো। মাথার এক্স-রে হলো। কিন্তু রোগের প্রকৃত ইতিহাস ফাতেমা কাউকে বলতে পারলো না। শুধু বললো পড়ে গিয়ে মাথায় চোট পেয়েছে। ডাক্তার খুব দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হলেন। বললেন-ঢাকায় নিয়ে গিয়ে একজন বড় ডাক্তার দেখিয়ে আনেন। ইতিমধ্যে বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। ফাতেমার বড় বড় চোখ থেকে মুক্তোদানার মতো চোখের জল ঝরে পড়ে। মনে হয় ওর সব সৌভাগ্য বুঝি ধুয়ে গেল। ফাতেমা আবার সন্তানসম্ভবা। চাপার বয়স মাত্র দু’বছর। শশুর-শাশুড়ির খুশির সীমা নেই, বউকে কতো যে যত্ন করেন, ফাতেমার চাকুরি করবার পাগলামীও কিছুটা কমেছে, সম্ভবত পরিস্থিতি উপলব্ধি করে। এর ভেতর একটা দুঃসংবাদ পেলো ফাতেমা চাপার চিঠিতে। ফাতেমাদি, আমি এখন স্বাধীন বাংলার স্বাধীন নাগরিক। করিম আমাকে তালাক দিয়েছে। অবশ্য বাবলুকে আমি রেখে দিয়েছি। ওর বয়স এখন পাঁচ, আমার শাশুড়ি আমার জন্য খুব কান্নাকাটি করেছেন। মনে হয় বাবলুকে ছেড়ে উনি বাঁচবেন না। আমি মাঝে মাঝে বাবলুকে ওর কাছে দিয়ে আসি। কিন্তু এভাবে তো আর বেশিদিন চলবে না। করিম এখানকার এক লেডী ডাক্তারকে বিয়ে করবে ঠিক করেছে। মহিলার রুচি দেখে আমি অবাক হলাম। আমি কিছুদিন আগে ঢাকায় পাঁচকাঠা জমি কিনেছিলাম। করিম হঠাৎ ওর নামে লিখে দেবার জন্য খুব পীড়াপীড়ি শুরু করে। ও ওখানে চেম্বার করবে। কিন্তু জমি আমার নামে থাকলে ক্ষতি কি? রোজ রোজ এক কথা নিয়ে ঝগড়া ঝাটি আমার ভালো লাগে না। আমি ব্যবস্থা করবার জন্য উকিলের কাছে গেলাম। উনি জমির কাগজপত্র সাবধানে রাখতে বললেন এবং পরিষ্কার বললেন, আপনার স্বামীর কোনও কুমতলব আছে আপনি। সাবধানে থাকবেন। শেষে সত্যিই একদিন বলে বসলো জমি ওকে লিখে না দিলে ও আমাকে তালাক দেবে এবং দিলোও তাই। আমি প্রতিবাদ করি নি। কারণ সে একটা হৃদয়হীন লম্পট এ আমি আগেই বুঝেছিলাম। তাই নিঃশব্দে সরে এসেছি। আমার জন্য কষ্ট পেয়ো না। ফাতেমাদি, এতো দুঃখ পার হয়ে যখন এসেছি তখন নিশ্চয়ই বাবলুকে বড় করতে পারবো! তাহের ভাইকে বলো সময় ও সুযোগ পেলে তোমাদের কাছে থেকে বেরিয়ে আসবো।’ চিঠি পড়ে তাহের অবাক হয়ে গেল। বললো, আমরা। অশিক্ষিত মূর্খ, ভাইসাহেব শিক্ষিত, একজন ডাক্তার এমন কাজ করলেন কি করে? তাহের বললো, চিঠির উত্তর আমি দেবো। তুমি আর এ নিয়ে মাথা ঘামিয়ো না লক্ষ্মীটি। ফাতেমা এখন আর তর্ক বিতর্ক ঝগড়াঝাটি করে না? সব সময়ই প্রায় চুপ চাপ থাকে না হয় বইপত্র পড়ে। তাহের লক্ষ্য করে, তার বিদ্যায় যতোটুকু কুলায় সে বই পছন্দ করে কিনে নিয়ে আসে। তাহেরের বাবা-মা দু’জনেরই বয়স হয়েছে, ফাতেমা চেষ্টা করে ওদের সেবাযত্ন করতে। কিন্তু ওর অসুস্থতার জন্য শাশুড়ি ওকে কিছু করতে দেয় না। একটা কাজের বুয়া রেখেছেন। এখন ও নিজেই সব দেখাশুনা করেন।