পেটের জ্বালা বড় ভয়ঙ্কর। মা উঠলেন, যাই হোক ডাল ভাত আলু সেদ্ধ করে সবাইকে খাওয়ালেন, নিজেও বোধহয় দশ মাস পর ভাত মুখে দিলেন। কিছুটা ভাত পাতের পাশে ঠেলে রাখলেন, মনে হলো পোনার ভাগটা সরিয়ে রাখলেন। আপা এ সর্বনাশ যার পরিবারে হয়েছে সেই শুধু এ বেদনার গভীরতা বোঝে। অন্যদের ক্ষমতা নেই এ দুঃসহ জ্বালা যন্ত্রণা উপলব্ধি করবার। আস্তে আস্তে সবই স্বাভাবিক হতে লাগলো। বাবা ক্ষেত-খামারে যান, আগের মতো বাজার হাটও করেন, ভাইয়ারাও কলেজে যায়, কিন্তু আমার কথা কেউ কিছু বলে না। একদিন বাবাকে বললাম, বাবা আমি কলেজে যাবো না? বাবা মাথা নিচু করে রইলেন। বললাম, কি হলো? কথা বলছো না যে, আমাকে আর পড়াবেনা? বাবা চাপাকে দেখিয়ে বললেন, তুই কলেজে গেলে ওই মেয়েটির কি উপায় হবে? কেন ওকেও স্কুলে ভর্তি করে দাও। বাবা বললেন, সেখানে তো ওর পরিচয়, ওর বাবার নাম সবই লাগবে দেখি কি করি। পরদিন সকালে বাবা গেলেন মতীন উকিলের বাড়ি। তাঁকে সব খুলে বললেন পার কথা এবং পরামর্শ চাইলেন। সতীশ বাবু রাজনীতি করেন। সকলে তাকে মান্যগণ্যও করে। চাপার বাবার পরিচয় পেয়ে তিনি অবাক হয়ে গেলেন।
বললেন, আমাকে দিন সাতেকের সময় দিন আমি ওর একটা উপযুক্ত ব্যবস্থা করে দেবো। শেষ পর্যন্ত চাঁপার ব্যবস্থা হলো। ঢাকায় নার্সিং এ চাপা ভর্তি হলো। এখন সামান্য টাকা পাবে অবশ্য তাতে ওর হয়ে যাবে। তারপর ট্রেনিং শেষ হলে ভালো মাইনে পাবে। চোখের জলে বুক ভিজিয়ে চাপা চলে গেল। তবে আজও চাপা ছুটি হলেই আমাদের বাড়িতে আসে। এ বিয়ে করেছে একজন মুসলিম ডাক্তারকে। ওর দুটি মেয়ে। চাকুরি ছাড়ে নি। মোটামুটি নিজেকে মানিয়ে নিয়েছে। কিন্তু আপা, পরের আশ্রিত আশ্রয় পেলো কিন্তু আমার কোনও গতি হলো না। কলেজে আর গেলাম না, প্রাইভেট পরীক্ষা দিয়ে বিএ পাশ করলাম। তারপর কত জায়গায় গেলাম চাকুরির আশায়, কিন্তু না, বীরাঙ্গনাকে জায়গা দিয়ে কেউ ঝাট ভোগ করতে রাজি না। স্কুলে চাকরি হবে না। মেয়েদের সামনে একজন চরিত্রহীন নষ্টা মেয়েকে আদর্শ রাখা যায় না। আমি পাগল হবার মতো অবস্থায় এলাম আপা। শেষ পর্যন্ত বাবা ঠিক করলেন আমার বিয়ে দেবেন। শুরু হলো পাত্র খোঁজা। অবশ্য যেখানেই বাবা কথা বলেছেন সবই খুলে বলেছেন। শেষ পর্যন্ত এক জায়গায় বাবার সবকিছু মন মতো হলো কিন্তু ছেলে ম্যাট্রিক পাশ। মা বললেন, সে কি করে হবে? আমার মেয়ে বিএ পাশ, বিয়ে দেবো ম্যাট্রিক পাশের সাথে। লোকে হাসবে না? তুমি আরেকটু দেখো ততোদিনে বাবারও ধৈর্যচ্যুতি হতে বসেছে। না, ছেলের স্বাস্থ্য, চেহারা ভালো, যথেষ্ট। জমিজমা আছে, খাওয়া পরার অভাব হবে না। তিন ভাই, এটিই সবচেয়ে ছোট। বড়রা কেউ লেখাপড়া করে নি। এই ছোট ছেলেই করেছিল। তারপর ব্যবসায় ঢুকে যায় ফলে আর পড়াশুনা করা হয়ে ওঠে নি।
শুভদিন শুভক্ষণে বিয়ে হয়ে গেল। ফাতেমা সত্যিই সুখী হলো। তাহের বেশ উঁচু মনের ছেলে। ফাতেমা নিজের কথা বলতেই তাহের তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলো। ও সব বলো না ফাতেমা, আমরা তোমাদের রক্ষা করতে পারি নি। আমরা আমাদের কর্তব্য করি নি। আর সেজন্য শাস্তি দেবো তোমাদের, তা হয় না। তুমি আমাদের ঘরের লক্ষ্মী, আমরা তোমাকে মাথায় করে রাখবো। মিথ্যে কথা বলে নি তাহের। সে ফাতেমাকে মাথায় করেই রেখেছিল। মুক্তিযুদ্ধের ওপর বই বেরুলেই ফাতেমাকে কিনে এনে দিতো। তাহের বুঝেছিল একখানা শাড়ির চেয়ে ফাতেমার কাছে একখানা বই অনেক বড়। ফাতেমার শ্বশুরও বেশ বর্ধিষ্ণুগৃহস্থ। একদিন এসে খবর দিলেন ফাতেমাকে গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াবার জন্য পাড়ার লোকেরা তাকে ধরেছে। ফাতেমার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে তিনি ওদের বলবেন। ফাতেমার ইচ্ছা পূর্ণ হলো। তার স্কুলে চাকুরিও হয়ে গেল। শ্বশুর মাইনে নিতে না করে দিলেন। ফাতেমা কিন্তু তাতে রাজি হয় নি।
সকাল সকাল ভাত খেয়ে স্কুলে চলে যায় ফিরে আসে বিকালে দুটোর সময়। শাশুড়ি সন্তুষ্ট না, ফাতেমা বোঝে। নানা রকম ভাবে তাকে খুশি করতে চেষ্টা করে কিন্তু তিনি গাল ফুলিয়েই থাকেন, ছেলের কাছে নানা কথা বলেন। তাহের একদিন বললো, ফাতেমা, আম্মা যখন চান না, তখন তুমি কাজটা না হয় ছেড়েই দাও। এক সময় ফাতেমা অন্তঃসত্ত্বা হলো। শাশুড়ি আরো ক্ষেপে গেলেন। পাঁচ-ছ’মাসের গর্ভাবস্থায় তাকে চাকুরি ছাড়তে হলো। শাশুড়ি তার দৈহিক অবস্থা নিয়ে নানা কটু কথা বলতে আরম্ভ করলেন। তাহেরের ব্যবসারও বেশ উন্নতি হচ্ছে। সে নিত্য নতুন জিনিস এনে ঘর সাজিয়ে তুলছে। ফাতেমা বাপের বাড়িতে খুব কম যায়। নেহায়েৎ বাবা নিতে এলে তাকে ফেরায় না, না হলে যেতে চায় না। দায় মুক্ত হবার জন্য যে তার বাবা একটি অশিক্ষিত পাত্রের হাতে তাকে সমর্পণ করেছেন এটা ফাতেমা ভুলতে পারে না। মনা ভালো চাকুরি করে। এখন ক্যাপ্টেন। বিএ পাশ মেয়ে বিয়ে করেছে। যদিও ওরা সবাই ওকে ও তাহেরকে খুবই মান মর্যাদা দেয় তবু ফাতেমার কোথায় যেন একটা অসম স্তরের কাঁটা ফুটে থাকে, সে তেমন করে সহজ হতে পারে না। বাবা-মা ভাবেন, নিজের অনেক বড় ঘর সংসার ফেলে সে কেমন করে থাকবে। অন্য জায়েরা নিজের বাড়িতে থাকে। বুড়ো শ্বশুর শাশুড়িকে তারই দেখতে হয়।