আমি চাপাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাপা তুমি এতো সব জানো কি করে? চাঁপা হাসলো, জানি কি করে? আমি বরিশালের মেয়ে। আমাদের দেশের মুকুন্দদাসের নাম শুনেছো? বললাম, স্বদেশী যাত্রা তো? কয়েকটা গানও আমি জানি। চাঁপার মুখও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো, জানো? অশ্বিনী দত্তের নাম শুনেছো? বললাম, শুনেছি কিন্তু ওর সম্পর্কে তেমন কিছুই জানি না। আসলে আমি তেমন শিক্ষিত ঘরের মেয়ে নই চাপা। তাই অতো কিছু জানি না। চাপা একটু চুপ করে থেকে বললো, ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এই যুদ্ধ পর্যন্ত আমার বাবা ৮/৯ বছর জেলে ছিলেন। এখন কোথায়? আমি প্রশ্ন করলাম। চাঁপা মুখ তুলে ওপরের দিকে দেখালো, বাবা স্বর্গে গেছেন। যাকে বলে শহীদ হয়েছেন। বাবা, মা ও আমার ছোট ভাইকে মেরে আমাকে টেনে নিয়ে এসেছে। বড় তিন ভাই আছে, জানি না তারা মুক্তিবাহিনীতে আছে, না তারাও শহীদ হয়েছে। তাড়াতাড়ি ওর মুখে হাত চাপা দিয়ে বললাম, না, না, ওরা আছেন। তুমি ফিরে গিয়ে ওদের পাবে। উত্তরে চাপা বললো, মিথ্যে সান্ত্বনা দিও না ফাতেমাদি। আমি হিন্দু ঘরের মেয়ে। আমাকে যখন স্পর্শ করেছে তাও আবার পাকিস্তানি সৈন্য, আমি কিভাবে ঘরে ফিরে যাব? তাহলে তুমি কি করবে? করবো একটা কিছু ভবে মরবো না। আমি হেরে যাবো না ফাতেমাদি। স্বাধীন বাংলাদেশে আমি স্বাধীন ভাবেই বাঁচবো। আশ্চর্য! রাত হলো, খাবার এলো কিন্তু রাতের অতিথিরা কেউ এলো না। চাপাকে জড়িয়ে ধরলাম। চাপা সুখবর তোমার কথাই ঠিক, জানোয়াররা গর্তে ঢুকেছে। নিঃশব্দে রাত পার হল। ফাতেমার মনে হলো দূরে বহুদূরে সে ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি শুনতে পাচ্ছে। যুদ্ধের কামানের বন্দুকের আওয়াজ আসিছে। সেও কি চাপার মতো মানসিক ব্যাধিগ্রস্ত হয়ে গেলো? চাপাও শুনেছে ওই শব্দ। সামনে একজন অফিসার এসে বললো, তোমাদের ছুটি দিয়ে দিলাম। তোমরা চলে যেতে পারো। চাপা রুখে দাঁড়ালো, আপনারা ছুটি দিলেই তো ছুটি নিতে পারি না স্যার। আমরা কোথায়, বাড়িঘর থেকে কতো দূরে কিছুই জানি না। তাছাড়া বিপদের দিনে আপনারা আমাদের জায়গা দিয়েছেন এখনও এক সঙ্গেই থাকবো। ভাগ্যে যা আছে সবার একরকমই হবে। ওর স্বচ্ছন্দ বাচনভঙ্গি আর ইংরেজি ও উর্দু ভাষার কথা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। দু’জন অফিসার কি যেন কানে কানে ফিস ফিস করে বললো। শেষ পর্যন্ত বললো, ঠিক আছে তোমরা থাকো। তিন-চারজন যাবার জন্যে খুব চেঁচামেচি শুরু করলো। চাপা তাদের বললো, বোনেরা ধৈর্য ধরুন। এখন আপনারা বাইরে বেরুলে শক্রর গুপ্তচর মনে করে আপনাদের গুলি করে মারবে মুক্তিবাহিনীরা। তাছাড়া আপনাদের দেখলে ওরা এদেরও খোঁজ পাবে। এখানে যুদ্ধ হবে। তার চেয়ে এরা যখন আত্মসমর্পণ করবে আমরা ওদের সাহায্য চাইবো, ওরা আমাদের বাড়ি-ঘরে পৌঁছে দেবে। যশোর থেকে গাড়ি এলো, মুক্তিযোদ্ধা ও ভারতীয় বাহিনীর। এরা হাত তুলে গাড়িতে গিয়ে উঠলো। ভারতীয় বাহিনীর একজন অফিসার আমাদের আলাদা একখানা ট্রাকে করে নিয়ে গেল। চাপা আর আমি জড়াজড়ি করে বসলাম-চাপা তোকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে যাবো, যাবি? আমরা কিন্তু মুসলমান। চাপা বললো, আমার কোনো জাত নেই ফাতেমাদি। আমি তো মৃত। এই আমি চাঁপার লাশ। যে আমাকে জায়গা দেবে আমি তারই কাছে যাবো আমাদের সোজা খুলনায় নিয়ে এলো। তারপর সব নাম ঠিকানা নিয়ে বললো টাকা পয়সা দিলে যেতে পারবো কিনা। বললাম পারবো, আর ঠাপাও আমার সঙ্গে যাবে।
একশ টাকার একখানা নোট হাতে করে রিকশা চেপে সোজা এসে উঠলাম সোনাডাঙ্গায় আমাদের বাড়িতে। বাবা আছেন। আমাকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। বললাম, বাবা পোনাকে বাঁচাতে পারি নি তার বদলে তোমার জন্যে আরেক মেয়ে এনেছি। চাঁপা বাবার পায়ে হাত দিতেই বাবা ওকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন। আমরা দু’জনে গোসল করে কাপড় বদলে মুড়ি আর গুড় নিয়ে বসলাম। বাবা বললেন, মাকে আনতে গেছে সোনা, তারা এসে পড়লো বলে। সোনা কাল ফিরেছে। অনেক রাতে। বাবা, মনা কেমন আছে? ভালো, কিন্তু সেও তো ছিল না। সে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ছিল। ও ফিরেছে ৪/৫ দিন আগে। শরীর এক এক জনের যা হয়েছে দেখলে চিনতে পারবি না মা। তোমার শরীর এমন করে ভেঙে গেছে কেন বাবা? তোর কথা ভেবে আমি আর তোর মা এক মিনিটও সুস্থির থাকতে পারি নি মা। নাসের আলী এখানে নানা কথা রটিয়েছে। আমরা অবশ্য দিনের বেলা আর এ বাড়িতে আসি নি। কখনও কখনও মনা রাতের বেলা এসে ঘুরে যেতো, ওর বন্ধু বান্ধবরাই বলেছে তুই নেই, তোকে মিলিটারিরা ধরে নিয়ে গেছে, মেরে ফেলেছে এইসব। সব মিথ্যে কথা বাবা, ওদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে আমি দূরে একটী গ্রামে চলে গিয়েছিলাম। সেখানেই তো ছিলাম। দেখো ভালোই আছি। বাবা আমার গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন কিন্তু বুঝলাম আমার কোনও কথাই বিশ্বাস করলেন না। চাপাকে অনেক কথা জিজ্ঞেস করলেন, ওকে অভয় দিলেন। সোনা, মনা ফিরে এলে ওর ভাইদের খবর এনে দেবে। ও অবশ্য ভাইদের কথা কিছুই বলে নি। এর ভেতর মা এসে পড়লেন। মাকে দেখে আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম মায়ের গায়ের রঙ যেন পুড়ে কালো হয়ে গেছে, কখানা হাড়, চামড়া দিয়ে ঢাকা, আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে ছেলে মেয়ে দুজনের জন্যেই কেঁদে আকুল হলেন। সোনার খবর তারা আগেই পেয়েছিলেন।