এখানে খাওয়া দিতো। ডাল, রুটি, ভাজি, রুটি আর সকালে চা-ও রুটি খেতাম। জানেন, মায়ের দেওয়া দুধ ভাত ফেলে দিয়েছি। কিন্তু শত্রুর দেওয়া জঘন্য খাবার পেট পুরে খেয়েছি। কারণ আমি ঠিক করেছিলাম আমি বাঁচবো, আমাকে বাঁচতে হবে এবং পোনার হত্যার প্রতিশোধ আমি নেবো। আমার তো সবই গেছে, আছে শুধু জানটুকু। এটুকুই আমি পোনার জন্য জিইয়ে রাখবো। যদি কখনও ছাড়া পাই ওই নাসিরকে আমি দেখে নেবো। তবে আমার কেন জানি না বিশ্বাস ছিল বাংলাদেশ স্বাধীন হবে, বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। কিন্তু যখন ভাবতাম আমি আর ওদের মাঝে ফিরে যাবো না, বিজয়ী বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পারবো না তখন চোখ ফেটে পানি আসতো, বুক ভেঙে যেতে চাইতো। কিন্তু আপা, আমি পেয়েছি। ঢাকায় সোনা আমাকে দূর থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখিয়ে এনেছে কিন্তু তখন কেন যেন আমার মনে হলো বঙ্গবন্ধুর চোখের আগুন অনেকটা নিভে এসেছে। হয়তো-বা দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন সর্বত্রই শান্তি দরকার। সোনা সেনাবাহিনীতে কাজ পেলো, মনা কলেজে ভর্তি হলো। কিন্তু আমি?
যশোরে আমাদের একটা ব্যারাক মতো লম্বা ঘরে রাখলো। অনেক মেয়ে ২০/২৫ জনের কম না। সবাই কিন্তু খুলনার না! বরিশাল, ফরিদপুর, যশোর এসব জায়গারও ছিল। তবে বেশির ভাগই আমার চেয়ে বয়সে বড়। একটাই মাত্র ১৪/১৫ বছরের বাচ্চা মেয়ে ছিল। খুব ফিস ফিস করে কথা বলতে হতো। দু’পাশের দরজাতেই পাহারাদার, আর শকুনীর মতো জমাদারণীগুলো তো ছিলই। তবুও মনে হতো এরা নাসির আলীর চেয়ে ভালো। নাসিরের লোকজন আমাকে সমানে পিটিয়েছে, দেখে দাঁত বের করে হেসেছে। পানি পানি করে চিৎকার করলে মুখে প্রস্রাব করে দিয়েছে। আমি কখনো ভাবতেও পারি নি মানুষ নামের জীব এমন জঘন্য হতে পারে। পরে অবশ্য বুঝেছি আগুন থেকে তপ্ত কড়াইয়ে পড়েছি। একটা নারীদেহ যে এমন বীভৎসভাবে বিকৃত উপভোগ্য হতে পারে তা বোধ হয় মনোবিজ্ঞানীরাও জানে না। অতগুলো মেয়ে এক সঙ্গে। শেষে মনে হতো আমরা সবাই ঘৃণা, লজ্জা, ভয়কে জয় করে ফেলেছি। একদিন এমন একটা কুৎসিত ঘটনা ঘটলো যা আপনাকে আমি কি করে বলবো ভেবে পাচ্ছি না। তবুও বলতে হবে, কারণ মানুষ না হলে জানবে না এই ফতি পাগলী তার দেশের জন্যে কি নির্যাতন সহ্য করেছে। একটা হিংস্র সিপাই ছিলো, সবার সঙ্গেই খারাপ ব্যবহার করতো। আমার সঙ্গে অতিরিক্ত দুর্ব্যবহার করতো। কারণ আমি জানি না। হয়তো-বা আমার দৃষ্টিতে ঘৃণা থাকতো বা অন্য কিছু। পাশ দিয়ে গেলেই একটা লাথি ছুঁড়ে দিলো। অখবা মাথায় একটা চাটি মারতো। চুপ করে সইতে হতো কারণ এর তো কোনও প্রতিকার নেই।
লোকটা একদিন মনে হলো নেশা করে এসেছে, ইসলামে নাকি মদ্যপান নিষিদ্ধ ও সব আইন কানুন এই মেনীমুখো বাঙালি মুসলমানদের জন্যই প্রযোজ্য। ওদের অনেককেই আমি মাতাল অবস্থায় দেখেছি। অফিসাররা তো নিয়মিত ক্লাবে বাড়িতে সর্বত্রই মদ খেতো। সিপাইরা আলাপ করতো।
একদিন পাড় মাতাল হয়ে এসে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমাকে উলঙ্গ করে কামড়ে খামচেও ওর তৃপ্তি হলো না, ওর পুরুষাঙ্গটা জোর করে আমার মুখের ভেতর ঢুকিয়ে দিলো। আমি নিরুপায় হয়ে আমার সব কটা দাঁত বসিয়ে দিলাম। লোকটা যন্ত্রণায় পশুর মতো একটা বীভৎস চিৎকার করে আমাকে ধাক্কা দিয়ে ঠেলে দিলো। আমি জানি আজই আমার শেষ দিন। আমাকে টেনে নিয়ে আমার পরনের লুঙ্গিটা দিয়ে আমার চুলের ঝুটি বেঁধে চেয়ারের ওপরে দাঁড়িয়ে পাখার সঙ্গে লটকে দিয়ে সুইচ অন করে দিলো। কয়েক মুহূর্ত চিৎকার করেছিলাম। তারপর আর জানি না, অন্য মেয়েরা বলেছে প্রথমে জানোয়ারগুলো হেসে উঠেছিল কিন্তু ভয়ে মরিয়া হয়ে মেয়েগুলো চিৎকার করায় বাইরে থেকে এক সুবেদার এসে পাখা বন্ধ করে দেয় ও আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। ঘটনাটা জানাজানি হয়ে যায়। ওই পটার কোর্ট মার্শাল হয়, তারপর আর ওকে দেখি নি। ৩/৪ দিন হাসপাতালে ছিলাম মাথায় অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে। কিন্তু জ্বর ছেড়ে দিতেই আমাকে আবার ওই ব্যারাকে পাঠিয়ে দিলো। অবশ্য কয়েকদিন আমার উপর কোনও নির্যাতন করে নি ওই পশুরা। কিন্তু আবার যথাপূর্বম তথা পরম।
বাইরের কোনও খবর পেতাম না। কিচেন থেকে একটা ছোকরা আমাদের খাবার দিয়ে যেতো। বয়স বছর কুড়ি হবে। বলতো, আপামণি কয়টাদিন একটু সয়ে থাকেন যা মাইর খাচ্ছে এরা বেশি দিন টিকবে না। কিন্তু ভয়ে বিশেষ কিছু বলতে পারতো না। এই লাঞ্ছিত মেয়েগুলোও কূটনামীতে কম যেতো না। এমনি করে একটা জমাদারণীর নামে লাগিয়েছিল একটা মাগুরার মেয়ে। জমাদারণীটাকে নাকি শেষ পর্যন্ত মেরেই ফেলেছিল। ওই মেয়েটার সঙ্গে আমরা কেউ কথা বলতাম না, কিন্তু খুব ভয় পেতাম যদি বানিয়ে বানিয়ে কিছু বলে। কিছুদিন পর ওকে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। আমরা কিছুটা ভয়মুক্ত হলাম। কতোদিন হবে জানি না তবে বৃষ্টি বন্ধ হয়ে গেছে। ভোররাতের দিকে কম্বল পায়ে দিই। আশ্বিন মাসে হবে বোধ হয়। একদিন আমাদের দুজনকে নিয়ে গেল। আমার কেন জানি না মনে হলো। যশোর থেকে কিছু লোকজন সরিয়ে ফেলবে। কারণ এটা তো ভারতের সীমান্ত। আগে কলকাতা যাবার সময় দেখেছি একটা বাশ টানা দিয়ে দুদেশ ভাগ করা। কে জানে কি হচ্ছে বাইরে? আমাদের রাতে নিয়ে এলো তাও চোখ বেঁধে। যেখানে এলাম মনে হয় শহরতলীতে, লোকজন গাড়ি ঘোড়ার আওয়াজ নেই। অবশ্য সেটা বোধ হয় ভোররাত ছিল। সকালে দেখলাম গ্রামের মতো। ঘরে চারটে জানালা ছিল। কিন্তু অনেক ওপরে। ওগুলো দিয়ে আলো বাতাস আসে, কিন্তু বাইরের জগৎ দেখা যায় না। তবুও আলো আসে, দিন হয়, রাত কাটে। এটুকু তো অন্তত বোঝা যায়। লোকজনগুলোও অপেক্ষাকৃত কম হিংস্র এবং এখানে রোজ রাতেই তারা আমাদের উপর হামলা করতো না। মনে হলো এটা কোনও মধ্যবর্তী স্টেশন মতো! এক জায়গায় থেকে অন্য জায়গায় যাবার পথে ওরা এখানে নামে এবং প্রায়োজনীয় নির্দেশ দিয়ে খাওয়া দাওয়া বিশ্রাম করে। হঠাৎ করে হৈ চৈ হয় আবার সব শান্ত হয়ে যায়। এক এক দিন সদলবলে হামলা করে। পৈশাচিক তাণ্ডবলীলা হয় আমাদের নিয়ে। তারপর আধমরা করে ফেলে রেখে আবার চলে যায়। এখনে আমরা নিচু গলায় কথা বলতে পারি কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে মন খুলে কথা বলার সাহস পাই না। জানি না তো কে কেমন, কার মনে কি আছে? যদি আবার লাগিয়ে দেয়। তবুও খাটো মতো একটা মেয়ে ছিল বরিশালের, নাম চাপা। সম্ভবত হিন্দু মেয়ে। ও দেয়ালে কান পেতে পেতে অনেক কথা শুনতো আর আমাকে বলতো। ও প্রায় সব সময়ই জানালার নিচে চুপ করে একা একা দাঁড়িয়ে থাকতো। একদিন বললো, আমাদের এখানে অনেক লোক আসছে। শীঘই ইন্ডিয়া যশোর আক্রমণ করবে। যশোরে যেসব অস্ত্র আছে তা দিয়ে ওদের মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তাই যশোর আক্রান্ত হলেই ওরা আত্মসমর্পণ করবে। এজন্য যাতে বেশি লোকক্ষয় না হয় সেজন্য ওদের একটু ভেতরে রাখবে। আত্মসমর্পণের পর তো আর অন্তত জানে মারবে না। আমার শেষের দিকে মনে হতো এসব কথা চাপা শোনে নি, কারণ অতো পুরু দেয়াল ভেদ করে শোনা কঠিন কাজ। তার উপর এসব কথা কি আর ওরা অতো জোরে জোরে বলবে। মনে হলো দিন রাত এসব কথা ভেবে ও নিজের মনেই এমন সব সিদ্ধান্তে এসেছে। শেষের দিকে আমার ভয় ভয় করতো, ও পাগল হয়ে যাবে নাকি। একেই আমার নিজের মাথায় যন্ত্রণা তার ওপর চাপার ওই সব আজগুবি কাহিনী আমাকে অস্থির করে তুললো। কিন্তু একদিন চাপা উত্তেজিতভাবে আমাকে এসে বললো, ফাতেমাদি, অনেক সোলজার এসেছে। আমি ক্রমাগত ট্রাকের শব্দ পাচ্ছি। খানিকক্ষণ কান পেতে থেকে আমিও শুনলাম সত্যি সত্যি ট্রাকের চাকার শব্দ। একটু পরেই ভেতরে অনেক লোকের চলাফেরা ধুপধাপ শব্দ শুনতে পেলাম। কিন্তু আগের মতো হট্টগোল নেই। সবাই যেন বেশ সংযত আচরণ করছে।