পাড়ার দুচারজন মুরুব্বি গোছের লোক বলতেন ফাতেমা একটু রয়ে সয়ে চলো। মেয়ে মানুষের এতো বাড়াবাড়ি ভালো না। যেদিন পুলিশ মিলিটারী ধরবে, সেদিন বুঝবে। দু’হাতের দুটো বুড়া আঙুল দেখিয়ে বলতাম, বিবি ফাতেমাকে ধরা অতো সোজা না, আপনারা ঠিক থাকবেন, তাহলেই হবে। আমার পরের ভাইর নাম সোনা মিঞা। ওর বয়স চৌদ্দ বছর। তারপর মনা, আর সব শেষে পোনা। ওরা দু’বছর পর পর। ওরাও আমাদের মতোই ক্লাস আর করে না। সোনা আর মোনা বড় বড় ছেলেদের পেছনে নিশান হাতে দৌড়োয়। তারপর আস্তে আস্তে সব শান্ত হলো। আবার আমরা পড়াশুনা শুরু করলাম। কিন্তু আমরা একটু অস্বস্তিতে ছিলাম। কাছেই খালিশপুরে বিহারী ভর্তি। ওরা সব সময়েই কেমন যেন দাম্ভিক ব্যবহার করতো। বড় তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতো। একবার তো রায়ট লেগে গেল, মরেছিলও অনেক লোক। রায়টটা হয়েছিল শ্রমিকদের ভেতর। তাই আমাদের একটু সাবধানে থাকতে হতো। এবার এলো নির্বাচনের পালা। সে কি আনন্দ, সব ভোট বঙ্গবন্ধুর। তখন আর তিনি শেখ মুজিব নন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মিটিং করতে খুলনা এসেছিলেন, এক নজর দেখবার জন্য আমরা সব ভেঙে পড়েছিলাম। গান্ধী পার্কে দেয়ালের ওপর চড়ে এক নজর দেখেছিলাম তাকে। উঃ সে আমি ভুলতে পারবো না। চারদিক থেকে গেছো মেয়ে, গুণ্ডা মেয়ে করে চেঁচাচ্ছে। শুনতে পাচ্ছি তবুও বঙ্গবন্ধুকে না দেখে নামছি না। আর নামলেই-বা কি? লাফ দিলেই তো কারও না কারও ঘাড়ে পড়বো। উঃ সে কি উত্তেজনা। মনে আছে মা বল্লো, কি হলো, আজ যে ভাত খেলি না। হেসে বললাম- মা আমার পেট ভরে গেছে খুশিতে। তোমার জন্য দুঃখ হচ্ছে মা, তুমি বঙ্গবন্ধুকে দেখলে না। আর কি চোখ মা…। থাক হয়েছে, ওঠ এবার।
হয়ে গেল নির্বাচন। বঙ্গবন্ধু হবেন এবারের সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী। ইঃ দেখবো এবার এই বিহারীর বাচ্চাদের। ওই নাসির কথায় কথায় বলে বাঙালি কুত্তা। দেখবো কে কাদের কুত্তা। কিন্তু এখন তো আর সবুর সইবে না, কিছুই ভালো লাগছে না। পরীক্ষাটাও আবার সামনে। আমি জানি বঙ্গবন্ধু প্রধানমন্ত্রী হলে এ বছর আর পরীক্ষা দেবো না শুধু আনন্দ আর ফুর্তি। পার্লামেন্ট বসছে না। ভুট্টো ঘোরাচ্ছে। পরিস্থিতি ভালো না। বেশ কয়েক জায়গায় গুলি চলেছে। বঙ্গবন্ধু অসহযোগ আন্দোলন ঘোষণা করলেন। সব বন্ধ। হাসপাতাল, পানি, বিদ্যুৎ ব্যাংক ছাড়া সব বন্ধ। বঙ্গবন্ধু বলেছেন ওদের আমরা ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। ভুট্টো সাহেব এলেন সদলবলে, মিটিং করলেন বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে, তারপর ছেড়ে গেলেন পূর্ব পাকিস্তান চিরকালের জন্য।
২৫ মার্চ পাকিস্তানের সকল বন্দুক, কামান, ট্যাঙ্ক, গর্জে উঠলো বাঙালি হত্যার। জন্য। যতোক্ষণ ঢাকার সঙ্গে টেলিফোন যোগাযোগ ছিল সব জানা গেল। তারপর শুধু গুজব আর গুজব। পরে জানলাম, যা ঘটেছে গুজব সেখানে তুচ্ছ। বঙ্গবন্ধু বন্দি হলেন। তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেল বিচার হবে। দাঁত কিড় মিড় করে ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিল। বিহারীরা গর্জে উঠলো। আমরা সব বাড়িঘর ছেড়ে পালাবো ঠিক করলাম। কলেজ হোস্টেলের ছাত্ররা সব চলে গেল। কেউ কেউ ওদের হাতে পড়ে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করলো। মিলিটারি আসছে। বিহারীরা স্লোগান দিচ্ছে, নারায়ে তাকবীর আল্লাহু আকবর। সামনে যা পেলাম নিয়ে সবাই গ্রামমুখী হলাম। কিন্তু নাসির আলীর হাত থেকে মুক্তি পেলাম না আমি আর পোনা। পোনাকে কোলে নিয়ে, আমি দৌড়োচ্ছিলাম, তাই সবার পেছনে পড়েছিলাম। ধরে ফেললো আমাকে, আমার গায়ের জোরও কম না। ওর সঙ্গে ধস্তাধস্তি করছি দেখে হঠাৎ পোনাকে তুলে একটা আছাড় দিলো। ওর মাথা ফেটে মগজ বেরিয়ে গেল। আমি চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। নাসির আরও দু’তিন জনকে সঙ্গে নিয়ে আমাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে চললো ওদের বাড়ির দিকে। সবাই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে তামাসা দেখছে। বাহাবা দিচ্ছে কেউ কেউ। আমি শুধু বোবা চোখে তাকিয়ে দেখছি। অবশ্য এদের মধ্যে বাঙালি ছিল কিনা আমি দেখি নি তবে আজ মনে হয় নিশ্চয়ই ছিল, তা না হলে আমাদের
আপা, ফাতেমা মরলো, ওই দিনই, ওই বস্তিতেই। বাপ ছেলে একই মেয়ের ওপর বলাক্কার করেছে শুনেছেন আপনারা? ওই পিশাচরা তাও করেছে। আমি একা নই আমাদের সোনাডাঙ্গা গ্রাম থেকে মা মেয়েকে এনেছে এক সঙ্গে, দু’জনকে পরস্পরের সামনে ধর্ষণ করেছে। হায়রে পাকিস্তানি সেনারা, কোথায় ছিল তখন তারা। তারা যখন আমাদের পেয়েছে আমরা তখন সবাই উচ্ছিষ্ট। চার-পাঁচদিন পর আমাদের একটা খোলা ট্রাকে করে যশোর নিয়ে এলো। আমরা দুহাতে মুখ ঢেকে বসেছিলাম। জনতা হর্ষধ্বনি দিচ্ছিলো। চোখে দেখি নি, কিন্তু মেয়ে মানুষের গলাও শুনেছি। জানি আপনারা বিশ্বাস করবেন না। কি করে করবেন? নিজেরা অমন বিপদে পড়েননি? আমার গা টা কেঁপে উঠলো। সত্যিই তো এমন বিপদের মুখোমুখি তো ছিলাম তবুও কিন্তু আল্লাহু বাঁচিয়েছেন? কি বললেন আপা, আল্লাহ্ বাঁচিয়েছেন। একটু তীর্যক হেসে ফাতেমা বললো, আল্লাহ্ কিন্তু বড় লোকের ডাক খুব শোনেন, গরীবের দিকে কান দেবার সময় কোথায়? ওর ম্লান হাসি দেখে মনে পড়লো একাত্তরে অসহযোগ আন্দোলনের সময় মীরপুরের বিহারীরা কিছু ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিলো। আমার একটি ছোট নাতনি তার বাবা-মার সঙ্গে দ্বিতীয় রাজধানীতে ছিল। আমাকে ফোন করে ভয়ে কাঁদছিল। আমি বললাম, নানু আল্লাহকে ডাকো। ও আরো জোরে কেঁদে উঠে বললো, নানু আল্লাহ্ বাংলা বোঝেন না। কতো ডাকছি শোনে না। মনে হলো লীনার অসহায় শিশুকণ্ঠ আমি আবার শুনলাম। আপা সারাদিন রাত আল্লাহকে ডেকেছি, কি লাভ হয়েছে? আজ আমার খেতাব ফতি পাগলী। যশোরে নামমাত্র মূল্যে আমরা বিক্রি হলাম। অর্থাৎ নাসির আলী হয়তো কারো হাতের পিঠ চাপড়ানো পেয়েছিল। দৈহিক নির্যাতন সয়ে এসেছি। পাকিস্তানি সৈন্য দেখলে ভয় করতো কিন্তু ওদের ভেতর ভালোমন্দ ছিল। কিন্তু নাসির আলীরা সত্যিই বেঈমান, কুত্তার বাচ্চা। অবশ্য জানেন আপা, সোনা আর তার সঙ্গের মুক্তিযোদ্ধারা নাসিরকে টুকরো টুকরো করেছে, কিন্তু ওদের দুঃখ কুকুর ধরে এনেছিল কিন্তু কুকুর ওর গোশত খায় নি। আপা, কুকুরেরও একটা জাত বিচার আছে। ওরা তো মানুষ না, তাই রক্ষা।