অফিসে খুবই ভালো ব্যবহার করলো। ময়নাকে একটা উপযুক্ত চাকুরি দেওয়া হলো এবং বাড়িটাও ওর নামে এ্যালোটে হলো। ময়না শুধু পুরোনো অফিলকে জানালো তার যদি ভালো না লাগে তাহলে কি তারা ওকে আবার নেবেন। তারা শুধু আশ্বাস নয়, আশ্বস্ত করলেন ময়নাকে।
নতুন জায়গায় কাজে যোগ দিলো ময়না। হারুন নেই তাও ভাবতে পারে না। ছোট গৌতমকে নিয়ে সব ভুলতে চায় ময়না। ভাবে আল্লাহ কি আমার জন্য শুধু দুঃখই সঞ্চয় করে রেখেছিলেন? তাহলে ক্ষণিকের সুখের মুখ কেন দেখালেন, কেন? দিন চলে যায়। ময়নারও যাচ্ছিল। হঠাৎ মনে হলো তার নতুন বম তার সুবিধা-অসুবিধার সম্পর্কে একটু বেশি সচেতন হয়ে উঠেছে। ময়না দেখেও দেখে না। শুনেও শোনে না। কিন্তু এভাবে কতোদিন চলে, সাত বছর হয়ে গেল হারুন চলে গেছে। গৌতম না এলে ও তো বিষ খেয়ে সব যন্ত্রণার অবসান ঘটাতে পারতো। এখন মাঝে মাঝে গৌতম সব অদ্ভুত প্রশ্ন করে। ওর বাবাকে কারা মেরেছে? কেন মেরেছে, কি করেছিল ওর বাবা? ময়না উত্তর দিতে পারে না। ইতোমধ্যে আব্বা মারা গেছেন তাই মা বেশির ভাগ সময়ই ওর কাছে থাকেন। ভাবি বড় ভালো মেয়ে। সংসার ভালোবাসে তাই মাকে আর ভাবতে হয় না। ময়না এখন মনে মনে গৌতমের ভবিষ্যৎ চিন্তা করে। ময়মনসিংহ ক্যাডেট স্কুলে একদিন ও গেল। হ্যাঁ দশ বছর বয়স হয়েছে। সুতরাং ও ছেলেকে আনতে পারে। পরীক্ষা দিতে হবে। গৌতম বাবার মতোই লেখাপড়ায় ভালো। পরীক্ষা দিলো, খুব ভালো ফল করলো। একদিন স্যুটকেস গুছিয়ে ময়না গৌতমকে ময়মনসিংহ রেখে এলো। তারপর বাসা খুঁজতে শুরু করলো ওর কলিগের সহায়তায়। এ বাড়ি পেয়ে কোম্পানির সাজানো বাড়ি ছেড়ে দিলো। বস্ দুঃখ করলেন, অফিসে অনেকেই আছে যাদের বাড়ির একান্তই প্রয়োজন। তারপর দশ বছর পরে ওর পুরোনো অফিসে ফিরে এলো। ময়না টাকা চায়না। চায় শান্তি। এ অফিস চাকুরি দিয়েছিলো একজন দুঃস্থ বীরাঙ্গনাকে, আর ওখানে মিসেস হারুন-অর-রশীদ সে লেবাস ও ছেড়ে এলো। ওর ঠিক এখন টাকার দরকার নেই। ও ছোট একটা ফ্ল্যাট কিনে ভাড়া দিয়েছে। ঐ টাকা থেকে গৌতমের সব খরচ চলে যায়। আর ময়নার তো বলতে গেলে কোনো খরচই নেই। মা চলে গেছেন। শ্বশুর-শাশুড়ি আগেই গেছেন। ছেলের শোক সহ্য করা ওদের পক্ষে সম্ভব হয় নি। আপা, আমি আবার রাজপথে এসে দাঁড়িয়েছি। আমি একজন বীরাঙ্গনা। যারা বারাঙ্গনা বানাতে চেয়েছিল তারা আমার স্বামীকে নিয়েছে। কিন্তু আমি বেঁচে আছি গৌতমের মা হয়ে। গৌতম হবে মুক্তিযোদ্ধার ছেলে মুক্তিযোদ্ধা। বাবা দেশ স্বাধীন করে গেছে। গৌতম সে দেশের জঞ্জাল সরিয়ে সোনার বাংলা গড়বে। এই সন্তানকে গড়ে তোলাই আজ বীরাঙ্গনা ময়নার শপথ।
৬. ফতি পাগলী
০৬.
আমার পরিচয়? না, দেবার মতো আমার কোনও পরিচয় আজ আর অবশিষ্ট নেই। পাড়ার ছেলে মেয়েরা আদর করে ডাকে ফতি পাগলী। সত্যি কথা বলতে কি আমি কিন্তু পাগল নই। যারা আমাকে পাগল বলে আসলে তারাই পাগল। এ সত্যি কথাটা ওরা জানে না।
বাবা-মা নাম রেখেছিলেন ফাতেমা। আমি প্রথম কন্যা সন্তান আমার জনকের। দাদি আদর করে বলেছিলেন দেখিস এ মেয়ে আমার বংশের মুখ উজ্জ্বল করবে। হযরতের কন্যা তো বিবি ফাতেমা। একটু বড় হয়ে নিজের নামের মাহাত্ম বুঝতে শিখেছি, একটু গর্বও ছিল সেজন্য। আমাদের বাড়ি ছিল খুলনা শহরের উপকণ্ঠে বর্তমান শিল্প শহর খালিশপুরের কাছে সোনাডাঙ্গায়। অবশ্য পাকা দালান নয়, কিছুটা ইট গাথা টিনের চাল। বেশ কয়েকটা আম, একটা কাঁঠাল, একটা চালতা আর একটা আমড়াগাছ ছিল। সেগুলোর জায়গা আমি এখনও দেখিয়ে দিতে পারি। কি যে বলি, এখানে তো এখন কয়েকতলা উঁচু বাড়ি। যাই হোক। বাড়িতেই লাউ, কুমড়া, শিম, পুঁই শাক সবই হতো। বাবা ছিলেন চাষী কিন্তু অন্যের ক্ষেতে কাজ করতেন না। তার নিজের জমির ধানেই পরিবার চলে যেতো। জমি ছিল শহর থেকে ৫/৬ মাইল দূরে। বাবা খুব পরিশ্রমী ছিলেন। জমির কাজে মজুর রাখতেন আর নিজে প্রতি হাটবার শাক সবজি, তরকারি এলাকা থেকে সস্তায় কিনে শনিবার আর মঙ্গলবার শহরের হাটে বিক্রি করতেন। তাতে যা লাভ হতো তা থেকেই ঐ হাট থেকে তিনি সপ্তাহের লবণ, মরিচ, সাবান, তেল ইত্যাদি কিনে আনতেন।
আমরা ছিলাম পাঁচ ভাই বোন। আমি বড়, তারপর তিন ভাই, সব ছোট একটি বোন, সবাই ডাকতো আদুরী। কারণ ভাইদের কোলে কোলে ও বড় হয়েছে। আর ছিলেন সবার মাথার উপর দাদি। দাদাকে আমি দেখি নি। তিনি আমার জন্মের আগেই মারা গেছেন। বাবা একমাত্র ছেলে, তার আর কোনও ভাই-বোন নেই। একটি ছিমছাম সুখী পরিবার। আদুরী ছাড়া আমরা সবাই স্কুলে যেতাম। স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে সবাই দুধভাত খেতাম, তারপর ছুটতাম খেলতে। পাড়ার মেয়েরা মিলে দৌড় ঝাঁপ করতাম। ছুটির দিনে পুকুরে বাজি ধরে এপার ওপার করতাম সবাই। ওঃ আমার চোখে পানি ও সব কথা ভাবলে পানি যে আপনিই আসে আপারা, বাঁধ মানে না। মাঝে মাঝে বাবা আমাদের শহরে নিয়ে যেতেন সিনেমা দেখাতে। উল্লাসিনী সিনেমা, পিকচার প্যালেস ওঃ সে সব কি বই দেখেছি।
এভাবেই চলছিল জীবন। আমি যে বছরে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দেবো সে বছরে শুরু হলো গোলমাল। আমরা মেতে গেলাম। পাকিস্তানিদের গোলামি আর করবো না। আমাদের দেশ থেকে দস্যুরা সব কেড়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের পাট বিক্রি করা পয়সা দিয়ে ওরা ইসলামাবাদে স্বর্গপুরী গড়ে তুলেছে আর আমরা দিন দিন গরীব হয়ে যাচ্ছি। এসব কথা বলবার জন্য শেখ মুজিবকে জেলে ধরে নিয়ে গেল সঙ্গে আরো মিলিটারী বাঙালি অফিসার ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেপ্তার করলো। বললো, শেখ মুজিব ভারতের সঙ্গে যোগসাজসে পাকিস্তান ধ্বংস করতে চেয়েছিলো। মামলার নাম হলো আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। বাব্বা সে কি মিটিং, মিছিল, বক্তৃতা, শ্লোগান। সবাই ভুলে গেলাম। বাবা পর্যন্ত মাঝে মাঝে হাটবারে তরকারি বেচতে যেতেন না। বলতেন ফাতেমার মা, শেখ মুজিবের যদি ফাঁসি হয় তাহলে আমাদের বেঁচে থেকে লাভ কি? ঢাকায় ছাত্ররা সব কিছু ওলট-পালট করে ফেলেছে। তারপর একদিন-উঃ সে কি আনন্দ শেখ মুজিব ছাড়া পেয়েছেন। সবাই তার গলায় ফুলের মালা পরিয়েছে। খুলনা শহরেও সে কি আনন্দ উৎসব। পুলিশ সব দূরে দাঁড়িয়ে দেখলো, কাছে এলো না। মনে হলো ওরাও খুশি।