অফিসারটি পরম সোহাগে আমাকে নিয়ে জিপে উঠলো। কিছুদূর যাবার পর সে গল্প জুড়লো অর্থাৎ তার কৃতিত্বের কথা আমাকে শোনাতে লাগলো। আমার মাথায় কিছুই ঢুকছিল না। হঠাৎ ঐ চলন্ত জিপ থেকে আমি লাফ দিলাম। ড্রাইভিংসিটে ছিল অফিসার, আমি পাশে, পেছনে দু’জন জোয়ান। আমার সম্ভবত হিতাহিত জ্ঞান রহিত হয়ে গিয়েছিল। যখন জ্ঞান হলো দেখি মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা, আমি হাসপাতালের বিছানায়। ছোট্ট হাসপাতাল। যতুই পেলাম, সব পুরুষ। একজন গ্রামের মেয়েকে ধরে এনেছে আমার নেহায়েৎ প্রয়োজনীয় সহায়তার জন্য। মেয়েটি গুণ গুণ করে কেঁদে চলেছে। সন্ধ্যায় অফিসারটি চলে গেল। যাবার সময় আমাকে হানি, ডার্লিং ইত্যাদি বলে খোদা হাফেজ করল। দিন তিনেক শুয়ে থাকবার পর উঠে বসলাম। সুস্থ হয়েছি এবার। আমাদের ভেতরে সংস্কার আছে পাঁঠা বা মহিষের খুঁত থাকলে তাকে দেবতার সামনে বলি দেওয়া যায় না। আমি এখন বলির উপযোগী।
প্রথম আমার উপর পাশবিক নির্যাতন করে একজন বাঙালি। আমি বিস্ময়ে বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। অসুস্থ দেহ, দুর্বল যুদ্ধ করতে পারলাম না। লালাসিক্ত পশুর শিকার হলাম। ওই রাতে কতজন আমার উপর অত্যাচার করেছিলো বলতে পারবো না, তবে ছ’সাত জনের মতো হবে। সকালে অফিসারটি এসে আমাকে ঐ অবস্থায় দেখলো তারপর চরম উত্তেজনা, কিছু মারধরও হলো। তারপর আমাকে তার জিপে তুলে নিলো, আমি তৃতীয় গন্তব্যে পৌঁছোলাম। অফিসারটির হাত ধরে মিনতি করে বললাম, আমাকে রক্ষা করবার কথা বলছেন, আমি তো রক্ষা পেয়েছি। এবার আমাকে ছেড়ে দিন। আপনি আমার ভাই। আপনার বয়সী আমার বড়ভাই আছে। হঠাৎ হিংস্র শ্বাপদের মতো এই ভালোমানুষ লোকটির চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। বা হাতে আমার চুলের মুঠি ধরে বললো, বল তোর ভাই কোথায়? বললাম, আমি তো এখানে ভাই কোথায় কি করে বলবো? অফিসারটি হঠাৎ আমার মুখে কতগুলো থুথু ছিটিয়ে দিয়ে কি সব গালাগালি দিলো। আমি নিস্তব্ধ নিথর বসে রইলাম। মনে হয়েছিল কেন আমি তার চরণে প্রথম অর্ঘ্য হলাম না, এটাই তার ক্ষোভ, কিন্তু সে তো তার অক্ষমতা। আমি তো এখন জড় পদার্থ, অনুভূতি প্রায় শূন্য। কয়েকদিন পর্যন্ত আমার মস্তিক মনে হয় কাজ করে নি। যন্ত্রের মতো যা দিয়েছে খেয়েছি, যে যেখানে টেনে নিয়ে যে অত্যাচার করেছে সয়ে গেছি। সামর্থ হলে দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করেছি “জয় বাংলা’। যদি কারও বোধগম্য হয়েছে তাহলে কিছু থুথু, কিছু লাথি উপহার পেয়েছি। আমাদের দেশ-গ্রামে প্রচলিত আছে, বিড়াল আর কচ্ছপের প্রাণ আর মেয়ে মানুষের প্রাণ একই রকম, যতোই অত্যাচার করো না কেন, ধিকি ধিকি জ্বলে, কিন্তু মরে না। আমার ও আমার মরণ-সঙ্গিনীদের ওপর এরা যে অত্যাচার করেছে, পুরুষ মানুষ হলে কবে নিঃশেষ হয়ে যেতো। অবশ্য এর পেছনে আরও একটা কারণ আছে। আমরা এদের জীবন যাপনের একটা অত্যাবশ্যক পদার্থ ছিলাম। তাই যতো অত্যাচারই করুক না কেন, আমাদের এই রক্ত-মাংসের দেহগুলোকে জিইয়ে রাখবার প্রয়োজন ছিল। এবার আমি যেখানে আছি ওখানে প্রায় আট-দশজন মেয়ে ছিল। বয়স তেরো থেকে ত্রিশ অথবা আরও বেশি হবে। তবে এরা সবাই প্রায় গ্রামের। একটা শহরের শিক্ষিতা মেয়ে দেখেছিলাম, সামান্য কথা বলবার সুযোগও পেয়েছিলাম। আমার চেয়ে বয়সে বড়, সুন্দরী। উনি নাকি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী। ওর দুই ভাই সামরিক বাহিনীতে আছে। তারা নিশ্চয়ই এতোদিনে মুক্তিযুদ্ধে লড়াই করছে। আমার মাথায় হাত দিয়ে বলেছিলেন, কোনও মতে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখো। আমাদের জয় হবেই। তার মুখেই শুনলাম ওটা জুলাই মাস। অবাক হলাম এতোদিন আমি এ নরকবাস করছি। ভগবান, যুদ্ধ আর কতোদিন চলবে। এদের দেখে তো এতোটুকু নিরুৎসাহ বা দুর্বল মনে হয় না। কিন্তু ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীকে সেইদিনই সন্ধ্যায় নিয়ে গেল। সম্ভবত আরো কোনও বড় সাহেবকে ভেট দেবে।
আমাদের শাড়ি পরতে বা দোপাট্টা ব্যবহার করতে দেওয়া হতো না। কোন ক্যাম্পে নাকি কোন মেয়ে গলার শাড়ির ফাঁস লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছে। তাই আমাদের পরনে পেটিকোট আর ব্লাউজ। যেমন ময়লা তেমনি ছেঁড়া-খোঁড়া। মাঝে মাঝে শহরের দোকান থেকে ঢালাও এনে আমাদের প্রতি ছুঁড়ে ছুঁড়ে দিতে। যেমন দুর্গাপূজা বা ঈদের সময় ভিক্ষা দেয় অথবা যাকাত দেয় ভিখারিকে। চোখ জলে ভরে উঠতো। বার বার বাবার কথা মনে হতো। মা এবার কি শাড়ি নিবি? বলতাম, তুমি যা দেবে। আদরে মাথায় হাত রেখে বলতেন, মা আমার যে ঘরে যাবে সে ঘর শান্তি তে ভরে উঠবে। বাবা তুমি কি জানতে তোমার মেয়ে কোনও ঘরের জন্যে জন্মায় নি। তার জন্মলগ্নে শনির দৃষ্টি ছিল। সে শতঘরের ঘরনী, যাযাবর রমণী।
হঠাৎ একদিন মনে হলো এতে অত্যাচার অনাচারে আমাকে এখন দেখতে কেমন হয়েছে? আয়না তো নেই ই কাঁচের জানালা-দরজাও নেই। পাছে আমরা আত্মহত্যা করি। ওরা জানে না এই লাঞ্ছিত দেহটাকে পরম মমতায় লালন করছি প্রতিহিংসা নেবার জন্যে। ঐ যে, যাকে কাকাবাবু বলতাম ওই চেয়ারম্যান, ওকে কি করবো? আচ্ছা শ্যামলদা এখন কোথায়? শ্যামলদা ইঞ্জিনিয়ারিং ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছিল। ঢাকায় ছিল ফলাফলের আশায়। ও আছে, না মরে গেছে? পুরুষ তো, নিশ্চয়ই মরে গেছে, ওকে ঘিরে কতো স্বপ্ন রচনা করতাম। সুন্দর সুঠাম দেহের অধিকারী, লাজুক প্রকৃতির ছিল শ্যামলা। সবার সামনে আমার সঙ্গে অল্প কথা বলতো। ওর বোন কাজলী আমাদের সঙ্গে পড়তো। বলতো, জানিস দাদা তোকে ভালোবাসে। শুনে আমার কান লাল হয়ে উঠতো, কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমতো। সত্যি মানুষ ভাবে কি, আর হয় কি। কোথায় আছে এখন শ্যামলদা। জীবিত, না মৃত, হয়তো-বা মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে ভারতে চলে গেছে। ভারতে এর বড়বোন, ভগ্নিপতি, কাকা, কাকিমা সব আছেন। ভালোই থাকবে ও। নিজের মনেই হাসে তারা, ঐ শ্যামলের কথা ভাববার কি কোনও যৌক্তিকতা আছে? ওর তন্দ্রাচ্ছন্ন ধ্যান ভাঙে মোতি মিয়ার চিৎকারে। মোতি মিয়া এখন রেশন সরবরাহ করে। মাঝে মাঝে তির্যক ভাষায় কিছু খবরাখবর দেয়। মাস-তারিখ হিসাবের ছলে উচ্চারণ করে। সেটা সেপ্টেম্বর মাস, মোতি মিয়া হিসাব করছিল। এ বছর যেতে আর তিনমাস। সাহেব তার থেকে বেশিদিন থাকবে না। হ্যাঁ, যুদ্ধ জয় করে দেশে বিবি বাচ্চার কাছে ফিরে যাবে। তারা বুঝলো মুক্তি আসন্ন। কারণ আজকাল ক্যাম্পে বসেই গোলাগুলির শব্দ শোনে। এখানকার অফিসার জোয়ান সবাই কেমন যেন উদ্বিগ্ন সন্ত্রস্ত। মাঝে মাঝে বাংলা খবর কানে আসে। না, ঢাকা-রাজশাহী নয়, উচ্চারণে বোঝা যায় আকাশবাণী। কে একজন বেশ ভরাট কণ্ঠে সংবাদ পরিবেশন করেন। শেষ হতেই রাজাকাররা গালাগালি দিতে থাকে মালাউনদের। তারা ভগবানকে ডাকে ওর প্রাণটুকু যেন থাকে। দাঁতে দাঁত চেপে উচ্চারণ করে ‘জয় বাংলা’।