আমি কিছু খাবার এবং ফুল এনে রাখলাম। বাইরে খেতে হবে না। কারণ ওর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জানবার আছে। আজ সাত বছর ধরে অনেক সময় আমি ওর কথা ভেবেছি। কাল রাতে ক্রিশ্চিন চলে গেলে আমি তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ একা। ভাবছিলাম নিজের দেশের কথা, অতীত সংগ্রামের দিনগুলোর কথা। সামনে পর্বত প্রমাণ আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, তারপর একদিন একটি মহান প্রাণের বিদায়ের মাধ্যমে সব আশা ছাই হয়ে গেল। কতো সুখ, কতো আপনজন হারিয়ে গেছে। মানুষের মুখোশ পরা কতো অমানুষ আজ আমার চারদিকে ভীড় জমিয়েছে। এই দশটা বছর তো দেহে বেঁচে আছি। অন্তরে আমি মৃত। কিন্তু কোথায় পথের কোনো বাঁকে এই বিদেশিনীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল? ভ্যানকুভারের শালী আমাকে বলেছিল গতজন্মে আমরা বোন ছিলাম। তাই এত দূরের হয়েও এতো কাছে এসেছি। ও খুব বেশি স্পিরিচুয়াল বিষয় নিয়ে চর্চা করে। অতো ধনী কিন্তু কি বিনয়ী, নিরাভরণ, অহঙ্কারশূন্য। বছরে একবার লন্ডনে এসে আমার মেয়ের কাছে আমার বড়দিনের উপহার রেখে যায়। মিসেস নিয়েলসনের সঙ্গেও কি ওইরকম কিছু? হঠাৎ আমার চোখের সামনে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠলো। ঐ তো, ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রে অপারেশন থিয়েটারের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। রুক্ষ্ম চুল, রক্তিমাভ ঠোঁট ফ্যাকাশে, পরনে একখানা লালপাড় শাদা শাড়ি, ভারতের সাহায্য। একেবারে অভ্রান্ত, না এতে কোনও সংশয় নেই। ওই তারা, কতোদিন ওর কাছে গেছি, কথা জমাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু হা
ছাড়া আর কোনও কথা হয় নি। এ নিশ্চয়ই সেই তারা কিন্তু জিজ্ঞেস করবো কি করে? মনে হয় ও আমাকে বলবে। কারণ যখনই ও কাছে আসে, আমার মেয়েদের মতো গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি বুঝি ও আমার স্পর্শ চায়। সেকি মাতৃস্পর্শ না দেশের মাটির স্পশ, জানি না। ঠিক সাতটায় দরজায় কলিংবেলের শব্দ হলো। আমি হাসিমুখে দরজা খুলে বলতে চেয়েছিলাম-হাই মিসেস নিয়েলসেন। কিন্তু বলা হলো না। হাতে একরাশ ফুল নিয়ে ও ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকে। আমি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওর মাথায়, পিঠে হাত বুলোত বুলাতে বললাম কেঁদো না, অনেক কেঁদেছো আর না। আজ তো তুমি জয়ী। যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো। ও উঠে গেল। আমি টেবিলে কিছু পানীয়, কাজু বাদাম আর আলুভাজা রাখলাম। মিসেস টি. নিয়েলসেন গুছিয়ে বসে গলা ভিজিয়ে বললো, নীলাআপা আমি প্রথম দিন দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আর আপনিও আমাকে চিনেছিলেন তাই না? তারা, তারা ব্যানার্জী, মনে আছে আপনার? অতোটা স্পষ্ট করে মনে না থাকলেও, তারা নামটা মনে পড়লো। একদিন কথাচ্ছলে বলেছিল ওর বড় বোনের রং শ্যামলা তাই ওর দাদি নাম রেখেছিলেন কালী। তারপর ওর জন্মের লগ্নে দাদি ওকে ডাকলেন তারা। একমাত্র বড় ভাইয়ের নাম স্বয়ম্ভ প্রসাদ। দাদির দেবী ভক্তির নমুনা আর কি! আমি চুপ করে শুনে যাচ্ছি, আজ ওর বলার পালা। এক সময় ওর মুখ খোলাতে আমি অনেক চেষ্টা করেও পারি নি। বললো, আপনি যখন আপনার সব বান্ধবীদের নাম ধরে ডাকতেন আর আমাকে বলতেন মিসেস নিয়েলসেন, আমি তখন লজ্জা পেতাম কিন্তু প্রথমে নামটা বলতে পারি নি। এখন আমার কোনও সংকোচ থাকার কথা নয়, তবে এ বোধহয় সংস্কারের দৈন্য। সব গেছে– জাতি, ধর্ম, দেশ কিন্তু ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কারকে সহজে বর্জন করতে আজও আমি দ্বিধাম্বিত্র।
১৯৭১ সালের উত্তাল আন্দোলনে আমি ছিলাম রাজশাহীতে। বাবা শহরের উপকণ্ঠে ডাক্তারি করতেন। এক সময় সরকারি কর্মচারী ছিলেন। ’৫২-এর ভাষা আন্দোলনের পর চাকুরি ছেড়ে তার গ্রামের বাড়ির কাছাকাছি শহরের উপকণ্ঠে বেশ কিছুটা জমি নিয়ে নিজের পছন্দমত ছোট্ট একটি বাড়ি করেন। মার আকাঙ্ক্ষা পূর্ণ হলো বাগান করবার সুবিধে পেয়ে। দাদি ততোদিনে চলে গেছেন। বড়বোন কালীর বিয়ে হয়ে গেল। ও কলকাতায় চলে গেল স্বামীর ঘর করতে। দাদার মেডিক্যাল কলেজের শেষ পরীক্ষা দেবার কথা, কিন্তু অসহযোগ আন্দোলনে এমনভাবে মেতে উঠলো যে দেওয়া হলো না। মা ক্ষুণ্ণ হলেন কিন্তু বাবা কেন জানি না খুশিই হয়েছেন মনে হলো। বাবা চেম্বার থেকে বেশ রাত করে আসেন। মা খুবই উদ্বিঘ্ন ইন, অনুযোগ অভিযোগ করেন। বাবা হেসে উত্তরে বলেন, শোনোনি শেখ মুজিব বলেছেন– তোমাদের যার যা কিছু আছে…। শুনেছি কিন্তু তোমার কি আছে, যে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়বে? বাবা বলতেন, ছেলে আছে, মেয়ে আছে, তুমি আছো। এখনও এই হাত দুখানা আছে। কিন্তু রাতে মনে হয় বাবা ঠিকমতো ঘুমাতেন না। সামান্য শব্দ হলেই জেগে উঠতেন। বারান্দায় পায়চারি করতেন। তিনি কি কোনও অশুভ সংকেত পেয়েছিলেন? জানি না, কারণ তিনি জানতে দেন নি।
মার্চমাসের মাঝামাঝির পর থেকেই এখানে ওখানে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছিল। কিন্তু জনতা এতো একতাবদ্ধ যে কোনো অপশক্তিই এদের রুখতে পারবে না বলে সবার দৃঢ় বিশ্বাস ছিল। সব বিশ্বাসকে ভেঙেচুরে এলো ২৫শের কালোরাত্রি। পরদিন ছিল কাফু। এর ভেতরই কিছু লোককে আমাদের বাড়ির চারদিকে ঘুর ঘুর করতে দেখা গেল। মা ঠাকুরের নাম জপ করছেন। বাবা করছেন অশান্ত পদচারণা। ছাব্বিশে মার্চ সারাদিনই আমরা ইঁদুরের মতো গর্তে রইলাম! ২৭ মার্চ অন্ধকার থাকতেই আমরা গ্রামের বাড়িতে রওয়ানা হলাম সামান্য হাতব্যাগ নিয়ে। গাড়ি, রিকশা কিছুই চলছে। হঠাৎ স্থানীয় চেয়ারম্যানের জিপ এসে থামলো আমাদের সামনে। বাবাকে সম্বোধন করে বললেন, ডাক্তারবাবু আসেন আমার সঙ্গে। কোথায় যাবেন নামিয়ে দিয়ে যাবো। বাবা আপত্তি করায় চার-পাঁচজনে আমাকে টেনে জিপে তুলে নিয়ে গেল। কোনও গোলাগুলির শব্দ শুনলাম না। বাবা-মাকে ধরে নিয়ে গেল না মেরে ফেললো বলতে পারবে না। গাড়ি আমাকে নিয়ে ছুটলো কোথায় জানি না। কিছুক্ষণ হয়তো জ্ঞান হারিয়ে ছিল আমার। সচেতন হয়ে উঠে বসতেই বুঝলাম এটা থানা, সামনে বসা আর্মি অফিসার। আমার সঙ্গে ভদ্রভাবেই কথা বললেন। বললাম, আমাকে বাবা-মার কাছ থেকে কেড়ে এখানে আনা হয়েছে কেন? অফিসার হেসে উত্তর দিলেন-তোমার নিরাপত্তার জন্য। দেখলাম ওখানে আরও ২৩টি মেয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কখনও বা চিৎকার করছে। অবশ্য চেঁচালেই ধমক খাচ্ছে। চা এলো, রুটি এলো, কলাও এলো। আপা, সে দৃশ্য আজও আমার কাছে পরিচ্ছন্ন স্পষ্ট। আমাদের মফস্বলের ইংরেজি শুনে অফিসারটি খুশী হলেন যে আমি ইংরেজি জানি। সারাদিন সবাই ওখানেই রইলাম। সন্ধের কিছু আগে চেয়ারম্যান সাহেব এলো। সব কিছু জেনেও আমি ওর পা জড়িয়ে ধরলাম, কাকাবাবু, আমাকে বাবার কাছে রেখে আসুন। ছোট্টবেলা থেকে আপনি আমাকে চেনেন। আপনার মেয়ে সুলতানার সঙ্গে আমি একসঙ্গে খেলাধুলা করেছি, স্কুলে পড়েছি। আমাকে দয়া করুন। উনি ঝাড়া দিয়ে আমাকে দূরে সরিয়ে দিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেলেন। বুঝলাম আমাকে বাঘের মুখে উৎসর্গ করা হলো। মানুষ কেমন করে মুহূর্তে পশু হয়ে যায় ওই প্রথম দেখলাম। এরপর ১৬ ডিসেম্বরের আগে মানুষ আর চোখে পড়ে নি।