১৯৮৫ সালে আবার গেলাম ডেনমার্কে। এ্যালী এসেছিল এয়ারপোর্টে ক্রিশ্চিন আর মেটার সঙ্গে। এবার হোটেল নয়, মেটার অফিসিয়াল রেসিডেন্সটা ক্রিশ্চিন আমাদের দু’জনের জন্য রেখেছে। মেটা ঐ দশদিন ওর বাবার বাড়িতে থাকবে। মেটা আইনজীবী এবং সংসদ সদস্য। হাতে সব সময় ক্যারনের মধ্যে একটা মোটা চুরুট। আপনারা বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, চুরুট খাওয়া মহিলারা প্রায়ই পুরুষালী আরচণ করেন। হয়তো এও আমার একটা ভ্রান্ত ধারণা। কক্সবাজারে ক্ষুদ্রাকৃতি বয়স্ক মগ মহিলারা যেন পার্টিতে বসে চুরুট ফুকছে। সদ্য ক্রিশ্চিনের ছেলের বিয়ে হয়েছে। সে পার্টি থেকে জমিয়ে বেশ কিছু মুরগির রোস্ট, বীফ স্টেক, পানীয় এনে মেটার ফ্রিজে জমিয়েছে। সন্ধেবেলায় আমার অবস্থানের খবর পেয়ে ভারতীয় প্রতিনিধি, আমাদের খুবই প্রিয়, লক্ষ্মী রঘু রামাইয়া এসে উপস্থিত। ক্রিশ্চিনের মুখে আষাঢ়ের মেঘ। আমার সঙ্গে ভালো করে কথাই বলছে না। নিজের মনে বিড় বিড় করছে, এ জানলে হোটেলেই যেতাম। ওর কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ও নিরামিষাষী। মাছ-মাংস খায় না। ক্রিশ্চিন এতোক্ষণে আত্মস্থ হলো।
জিজ্ঞেস করলাম মিসেস নিয়েলসেনের কথা। সংক্ষিপ্ত উত্তর, ভালোই আছে। এ্যলীর খবর কি? দেখাই তো হবে কাল। একটা রাত না হয় আমার সঙ্গেই গল্প করে কাটিয়ে দিলে। ক্রিশ্চিন আমার থেকে দু’চার বছরের ছোট অথবা আমার সমবয়সী হবে। ও আমাকে ভয়ানক ভালোবাসে। পারিবারিক সুখ-দুঃখ-সমস্যার কথা আমাকে বলে খুব শান্তি পায়। তাই ওর সামনে আর কারো সম্পর্কে আগ্রহ দেখালে ও একটু বিরক্তই হয়। তাছাড়া একান্ত আড্ডা মারা আর সন্ধ্যায় রেস্তোরাঁয় গিয়ে পিটজা খাওয়ায় ওর যতো সুখ। আর সেই সুখের জন্য মেটাকে ঘর ছাড়া করেছে দশদিনের জন্য।
একটা চেক ব্যাভিরিয়ন স্কার্ট পরা, সঙ্গে একটা লাল টুকটুকে ব্লাউজ-নিয়েলসেন আমাকে দেখে দৌড়ে এসে জড়িয়ে ধরলো। কিন্তু চুমুটা দিলাম আমি, ও ঠিক সহজভাবে আমার মুখ চুম্বন করলো না। আগামীকাল থেকে মধ্যদশক নারী কংগ্রেস শুরু। আজ এসেছি রেজিস্ট্রেশন করতে আর ঘর-বাড়ি দেখতে। যেন কাল হাতড়ে বেড়াতে না হয়। টি. নিয়েলসেনের হাত ধরে আছে ৫৬ বছরের একটা ফুটফুটে মেয়ে। হঠাৎ বললো, মিসেস হায়দার আমার মেয়ে, নোরা’। নোরা মায়ের মতো অতো সপ্রতিভ নয়। ‘হাই’ বলেই মায়ের পেছনে মুখ লুকালো। বললাম, টমাসের খবর কি? আরে ও এখন জেন্টলমান। শোনো, এবার তুমি একা আমাকে একটা সন্ধ্যা দেবে, প্লিজ। বললাম, একা? বলল, হ্যাঁ, অনেক কথা আমার তোমার কাছ থেকে জানার আছে। বিস্ময় ক্রমশ বাড়ছে। তারপর দিন ঠিক হলো কনফারেন্স থেকে আমি ক্রিশ্চিনের সঙ্গে ওর বাড়ি রানু যাবো। তার আগের দিন ও চলে গেল। আমি মিসেস নিয়েলসেনকে ঐ দিন রাতে আসতে বললাম। উনি সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন।
আমি কিছু খাবার এবং ফল এনে রাখলাম। বাইরে খেতে হবে না। কারণ ওর কাছ থেকে আমার অনেক কিছু জানবার আছে। আজ সাত বছর ধরে অনেক সময় আমি ওর কথা ভেবেছি। কাল রাতে ক্রিশ্চিন চলে গেলে আমি তারা ভরা আকাশের দিকে চেয়েছিলাম। সম্পূর্ণ একা। ভাবছিলাম নিজের দেশের কথা, অতীত সম্ভ্রমের দিনগুলোর কথা। সামনে পর্বত প্রমাণ আশা নিয়ে এগিয়ে যাওয়া, তারপর একদিন একটি মহান প্রাণের বিদায়ের মাধ্যমে সব আশা ছাই হয়ে গেল। কতো সুখ, কতো আপনজন হারিয়ে গেছে। মানুষের মুখোশ পরা কতো অমানুষ আজ আমার চারদিকে ভীড় জমিয়েছে। এই দশটা বছর তো দেহে বেঁচে আছি। অন্তরে আমি মৃত। কিন্তু কোথায় পথের কোনো বাঁকে এই বিদেশিনীর সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল? ভ্যানকুভারের শালী আমাকে বলেছিল গতজন্যে আমরা বোন ছিলাম। তাই এত দূরের হয়েও এতো কাছে এসেছি। ও খুব বেশি স্পিরিচুয়াল বিষয় নিয়ে চর্চা করে। অতো ধনী কিন্তু কি বিনয়ী, নিরাভরণ, অহঙ্কারশূন্য। বছরে একবার লন্ডনে এসে আমার মেয়ের কাছে আমার বড়দিনের উপহার রেখে যায়। মিসেস নিয়েলসনের সঙ্গেও কি ওইরকম কিছু? হঠাৎ আমার চোখের সামনে হাজার পাওয়ারের বাতি জ্বলে উঠলো। ঐ তো, ধানমন্ডির নারী পুনর্বাসনকেন্দ্রে অপারেশন থিয়েটারের দরজার পাশে দাঁড়িয়ে মেয়েটি। রুক্ষ্ম চুল, রক্তিমাভ ঠোঁট ফ্যাকাশে, পরনে একখানা লালপাড় শাদা শাড়ি, ভারতের সাহায্য। একেবারে অভ্রান্ত, না এতে কোনও সংশয় নেই। ওই তারা, কতোদিন ওর কাছে গেছি, কথা জমাতে চেষ্টা করেছি, কিন্তু হ্যাঁ-না ছাড়া আর কোনও কথা হয় নি। এ নিশ্চয়ই সেই তারা কিন্তু জিজ্ঞেস করবো কি করে? মনে হয় ও আমাকে বলবে। কারণ যখনই ও কাছে আসে, আমার মেয়েদের মতো গা ঘেঁষে দাঁড়ায়। আমি বুঝি ও আমার স্পর্শ চায়। সে কি মাতৃস্পর্শ না দেশের মাটির স্পর্শ, জানি না।
ঠিক সাতটায় দরজায় কলিংবেলের শব্দ হলো। আমি হাসিমুখে দরজা খুলে বলতে চেয়েছিলাম-হাই মিসেস নিয়েলসেন। কিন্তু বলা হলো না। হাতে একরাশ ফুল নিয়ে ও ঝাঁপিয়ে পড়লো আমার বুকে। আমি আস্তে দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে ওর মাথায়, পিঠে হাত বুলাতে বুলোতে বললাম কেঁদো না, অনেক কেঁদেছো আর না। আজ তো তুমি জয়ী। যাও মুখ হাত ধুয়ে এসো। ও উঠে গেল। আমি টেবিলে কিছু পানীয়, কাজু বাদাম আর আলুভাজা রাখলাম। মিসেস টি. নিয়েলসেন গুছিয়ে বসে গলা ভিজিয়ে বললো, নীলাআপা আমি প্রথম দিন দেখেই আপনাকে চিনতে পেরেছিলাম। আর আপনিও আমাকে চিনেছিলেন তাই না? তারা, তারা ব্যানার্জী, মনে আছে আপনার? অতোটা স্পষ্ট করে মনে না থাকলেও, তারা নামটা মনে হয়ে গেলেন।