সত্যিই আজ আমি শুধু বিস্মিত নই, আবেগাপ্লুতও যে আমার মাতৃতুল্য একজন বয়স্ক মহিলা আমার সম্মুখে এতো মমতামাখা আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে এসেছেন। কিন্তু আজ দীর্ঘ বিশ বছর পর আমি দাঁড়িয়ে আছি বর্তমানের ওপর দু’পায়ে ভর করে। ভবিষ্যতের বুক ভরা আশা নিয়েও আমার অতীত নেই মনের সমস্ত দৃঢ়তা ও ঘৃণাকে সম্বল করে আমি আমার কলঙ্ক আচ্ছাদিত গৌরবময় অতীতকে ভুলে গেছি। কারণ আমার যা ছিল গর্বের, আমার পরিবার ও সমাজের তাই ছিল সর্বাধিক লজ্জা, ভয় ও ঘৃণার।
ওহো, আমি দুঃখিত। নিজের পরিচয় দিতে আমি ভুলে গেছি। আজকাল আমার মাঝে মাঝে এমন হয়, কারণ বড় বেশি কাজের চাপে থাকি। এর সুবিধা দুটো। বর্তমানকে আমার চিন্তা-ভাবনা, অনুভূতি ও যোগ্যতা দিয়ে সব সময়ে পূর্ণ করে রাখতে চাই, যেন অতীত সেখানে কখনও কোনো ছিদ্রপথে প্রবেশ করতে না পারে। আমার বর্তমান যেন মসীলিপ্ত না হয়। আমার নাম মিসেস টি. নিয়েলসেন। আমার স্বামী যশস্বী সাংবাদিক ও ডেনমার্কের অধিবাসী। সঙ্গত কারণে আমিও তাই। আমাদের দুটি ছেলেমেয়ে টমাস ও নোরা! মেয়ের নাম নোরা রাখলাম কেন? সম্ভবত আমাকে দেখেই আমার শাশুড়ি নাতনির এ নাম রেখেছিলেন। তাঁর মত, শতবর্ষেরও আগে ইবসেন তাঁর দেশে যে নারীকে ব্যক্তি সচেতন করতে চেয়েছিলেন আজ পাশ্চাত্যেও নারী সে-অধিকার বা সম্মান অর্জনে সক্ষম হয় নি। তবে নোরা যেন তার কালের ওপর দাঁড়িয়ে ইবসেনের স্বপ্ন সফল করে। টমাস পেয়েছে আমার স্বভাব জিন্দী, একগুয়ে আর মোরা তার বাবার মতো, আগুনের কাছে গেলেও গরম হয় না।
১৯৭৮ সালে মিসেস হায়দার ডেনমার্কে আসেন। যে-সংগঠনের তিনি সদস্য তারা কোপেনহেগেনে একটি প্রেসকনফারেন্স করে। আমার বান্ধবী এ্যালিস একজন নারীবাদী জবরদস্ত সাংবাদিক। সেও ওখানে ছিল। নিয়েলসেনের বাংলাদেশ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা থাকায় সে মিসেস হায়দারকে বারবার ও দেশের স্বাধীনতা উত্তরকালের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করলো। মিসেস হায়দার অত্যন্ত উচ্চশিক্ষিত, প্রগতিশীল এবং স্পষ্টভাষী। কিন্তু তিনি সব কথার সোজাসুজি উত্তর দিচ্ছিলেন না। তিনি আমার সাখীকে বললেন, আমার দেশে গণতান্ত্রিক সরকার নেই তাই তোমাদের মতো সরাসরি আমরা কথা বলতে পারি না। আশা করি আমার এ অনিচ্ছাকৃত অক্ষমতাকে তোমরা ক্ষমা করবে। আনুষ্ঠানিক প্রেস-কনফারেন্স শেষ হলে এ্যালি ও নিয়েলসেন বেশি সময় মিসেস হায়দারের সঙ্গে কাটিয়ে এলো। যে-সংগঠনের পক্ষ থেকে এ প্রেস-কনফারেন্স ডাকা হয়েছিল, এ্যালিস ঐ সংগঠনের ডেনমার্ক শাখার প্রচার সম্পাদক।
মিসেস টি. নিয়েলসেনের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৭৮ সালে কোপেনহেগেনে এ্যালিসের বাড়িতে এক নৈশভোজে ইন্টারন্যাশনাল এ্যালায়েন্স অব উইমেনের বোর্ডমিটিং ও বছর কোপেনহেগেনে হয়। সহ-সভানেত্রী লরেল ক্যাসিনার কন্যা, পদ্মিনী ডেনমার্ক শাখার সভানেত্রী। তারই অনুরোধে আমরা কোপেনহেগেনে সভা করবার সিদ্ধান্ত নিই। পদিনীর স্বামী ডেনিশ, পেশায় চিকিৎসক। তাছাড়া আরও কয়েকজন স্থানীয় সদস্য আমাদের পূর্ব পরিচিত, যে পরিচয় আজ বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছে। এ্যালিস তাদের একজন। নৈশভোজে প্রায় পঁচিশ-ত্রিশজন ছিলেন। এলিস আগ্রহ সহকারে মি. এবং মিসেস নিয়েলসেনের সঙ্গে আমার পরিচয়-করিয়ে দিলো, যদিও নিয়েলসেনের সঙ্গে আমি প্রেসকনফারেন্সে আগেই পরিচিত হয়েছি এবং তাকে আমার বেশ ভালো লেগেছিলো।
মিসেস নিয়েলসেনের সঙ্গে পরিচিত হয়ে, একটু যেন চমকে উঠলাম। মহিলার বয়স বছর ত্রিশ মতো হবে। রীতিমতো সুন্দরী ও সুঠাম দেহের অধিকারিণী। কালো ঈষৎ কোঁকড়া চুলে পিঠ ছেয়ে আছে, যা এদেশে চোখে পড়ে না। বেশির ভাগেরই বাট অথবা হাল ফ্যাশনের বয়কাট। সুতরাং চুলেই মহিলা সবার দৃষ্টি কাড়তে সক্ষম, গায়ের রঙটাও ঠিক পশ্চিমী দুধে আলতায় নয়, অনেকটা ল্যাটিন আমেরিকার মেয়েদের মতো হলদে ছাট আছে। চুলের সঙ্গে মিল রেখে চোখ দুটিও বড় বেশি কালো। দৃষ্টি চঞ্চল, সম্ভবত স্বভাবেও কিছুটা চাঞ্চল্য আছে। ঘুরে ঘুরে সবার সঙ্গে গল্প করছেন, হাসছেন একান্তভাবেই উচ্ছল প্রকৃতির। আমি কিন্তু বারবার ওর দিকে তাকাচ্ছি। কোথায় কি যেন আমার মাথায় নড়েচড়ে বেড়াচ্ছে। উনি কি আমার পূর্ব পরিচিত? ওকে কি কোথায়ও দেখেছি। সম্ভবত মেক্সিকোতে দেখে থাকবো, কারণ ডেনমার্ক থেকে ওখানে বড় ডেলিগেশন গিয়েছিল। উনিও কিন্তু বারবার আমার দিকে চোখ ফেলছেন। কিন্তু কেন? আমার চোখের দৃষ্টি কি মনের ঔৎসুক্য প্রকাশ করছে? সে এগিয়ে এলো। হেসে বললাম, তোমাকে আমার খুব পরিচিত মনে হচ্ছে। কোথায় তোমাকে দেখেছি বলতো? মনে হয় আমাকেও তুমি কিছুটা চেনো। মিসেস নিয়েলসেন বললেন, তুমি তো বিশ্বপরিব্রাজক নও। হয়তো-বা তোমার বাংলাদেশের মাটিতেই আমাকে দেখেছো। চোখ দুটো কৌতুকে হাসছে। সত্যি? গিয়েছিলে তুমি নিয়েলসেনের সঙ্গে বাংলাদেশে? আমাকে একটা মৃদু ঠেলা দিয়ে বললেন, লোকে বলে তুমি নাকি খুব জ্ঞানী, পণ্ডিত। কিন্তু একেবারে শিশুর মতো সরল। ‘হাই’ বলে আরেকজনের দিকে ছুটলেন তিনি। সে রাতের দেখা সাক্ষাৎ ওখানেই শেষ।
পরে এ্যালিসের সঙ্গে ওর সম্পর্কে অনেক আলাপ হয়েছে। এ্যালিসও আমার সঙ্গে একমত, খুব ইন্টারেস্টিং মহিলা। না, ইনি ডেনমার্কের নন। হয়তো-বা তোমার কথাই ঠিক, ল্যাটিন আমেরিকার কোনো দেশের হবে। কিন্তু কথায় তো ওসব দেশের টান নেই। জিভ একেবারে পরিষ্কার মনে হয় অক্সফোর্ড, কেন্ত্রিজে পড়াশোনা করেছে। কিন্তু তাও নয় নীলা, কারণ উনি পেশায় নার্স, অবশ্য খুবই দক্ষ। একটা বেশ সম্মান নিয়েই আছেন এখানে। আচ্ছা নীলা, কি পেয়েছো তুমি মিসেস নিয়েলসেনের ভেতর যে ওর সম্পর্কে এতো কিছু জানতে চাইছো? বললাম, কিছু না এ্যালী। এমনিই ওকে আমার খুব ভালো লেগেছে।