তবুও বাড়ি ফেরার লোভটাকে কিছুতেই ছাড়তে পারছিলাম না। সেই শোবার ঘরের কোণের শিউলী গাছটী, মা রোজ সকালে ওজু করে এক বদনা পানি ওর গোড়ায় ঢালতেন। ডিসেম্বর মাস, না ফুল এখনও শেষ হয় নি। পাড়ার মেয়েরা হেনা, রাবু সব আসতো ফুল কুড়াতে। বাবাকে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলাম ওরা কি আছে না আমার মতো হারিয়ে গেছে? আর কখনও ওই ফুল ছুঁয়ে দেখবো না। আমি তো আজ সবার কাছে অপবিত্র, অস্পৃশ্য! মনে পড়লো রান্না ঘরের মেঝেতে পিড়ি পেতে রাতে সবাই একসঙ্গে খেতে বসতাম। মা সবাইকে দিয়ে পরে নিজে খেতেন। আমার খাওয়া হলে উঠে যেতাম পড়াশোনার তাগিদে। মা খেতেন। বাবা বসে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করতেন। কুপির আলো মায়ের মুখের একপাশে এসে পড়তো, আলোর শিখাটা কাঁপতে মায়ের মুখও, যেন কেঁপে কেঁপে উঠতো। হঠাৎ ডুকরে ডুকরে কেঁদে উঠলাম, মা, মাগো। সঙ্গীরা সান্ত্বনা দিতো। তবুও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সীমা ছিল না।
তারপর একদিন তিনজন আপা এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাদের সঙ্গে কথা বলতে! খুঁটে খুঁটে সব শুনে বললেন, কেন তোমরা পাকিস্তানে চলে যাচ্ছো? দেশ তোমাদের দায়িত্ব নেবে। প্রধানমন্ত্রী তোমাদের বীরাঙ্গনা খেতাব দিয়েছেন শোনোনি? নীরা আপা, সবচেয়ে শিক্ষিত, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের ছাত্রী ছিলেন। তিনি আপাদের সঙ্গে যথেষ্ট তর্ক বিতর্ক করলেন। ইতিমধ্যে আগত তিন আপার নাম জেনেছি নওশাবা, শরীফা আর নীলিমা। এরা এসেছে আমাদের ফিরিয়ে নিতে। হঠাৎ করে ঐদিন আবার বাবাও এসে উপস্থিত হয়েছেন। আমাদের ভেতর অধিকাংশই বিবাহিত ছিলেন, তাঁদের স্বামী এসেছে, কথা বলেছেন, কেউ কেউ শাড়ি উপহার দিয়ে গেছেন, কিন্তু ফিরিয়ে নিতে পারবেন না একথা অসংকোচে জানিয়ে গেছেন। কারণ তাদের সমাজ আছে, সমাজে আর পাঁচজন আছে। তাদের ভেতর তো এ ভ্ৰষ্টা কলঙ্কিনীদের নিয়ে তোলা যাবে না। স্বামীর ইচ্ছা আছে তবে উপায় নেই। এসব মন্তব্য থেকে আমরাও আমাদের অবস্থান জেনে নিয়েছিলাম! স্বামী যখন ঠাই দিতে পারে না, তখন কোন রাজপুত্র আমাদের যেচে এসে ঘরে নেবে। সুতরাং না, আমরা আমাদের সিদ্ধান্তে অটল। আমার বয়স ছিল সবচেয়ে ম। আমি বললাম- আপনারা যে আমাকে থাকতে বলছেন আমি কোথায় থাকবো?
এক আপা বললেন, কেন, তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে এসেছেন, বললাম বাবার ঘাড়ের বোঝা হবো না। এক আপা বললেন, বেশ তো তুমি আমার কাছেই থাকবে। হঠাৎ কেন জানি না আমি জ্বলে উঠলাম, আপনার কাছে থাকবোর প্রতিদিন চিড়িয়াখানার জীবের মতো আমাদের দেখার জন্য আপনার বাড়ির দরজায় দর্শনার্থীর ভীড় হবে। আপনি গর্বিত মুখে আমাকে দেখাবেন কিন্তু তারপর আমার ভবিষ্যৎ কি হবে? ঐ আপা আমার আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বললেন, পাকিস্তানে যেতে চাও? ওখানে কি পাবে। ওখানে তো তোমাকে নিয়ে পতিতালয়ে বিক্রি করে দেবে এরা। তাতে তোমার কোনো সুবিধা হবে? সুবিধা এই হবে আপা ওখানে পতিতাবৃত্তিই করি আর রাস্তাই ঝাড় দেই লোকে আমাকে চিনবে না, স্বামী সন্তান অন্তত সামনে দাঁড়িয়ে টিটকারী দেবে না। ওরা ক্ষুব্ধ হয়ে চোখ মুছে চলে গেলেন। শুনেছি কলকাতা থাকতেই নীরা আপাকে তার ভাইয়েরা ফিরিয়ে নিয়ে গেছে। জানি না, তিনি কোথায় কতোটা সুখ ও সম্মানের জীবন যাপন করছেন।
বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। চারদিকে স্বাধীনতার উৎসব। শুধু অন্ধকার গুহায় সর্বস্বান্ত আমরা ক’জন বন্দিনী নিঃস্ব রিক্ত। আজ নিজেকে বাঙালি বলে পরিচয় দেবার সম্বলটুকুও আমরা খুইয়ে বসে আছি। কেন এমন হলো? শুধু আমরা নারী বলেই অপবিত্র আর রাজাকার আল-বদরেরা পাপ করেও আজ সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তি। এ তোমার কেমন বিচার আল্লাহ? তবে তোমার কাছে নাকি সব সমান? আল্লাহর কানে শুধু পুরুষের বক্তব্যই পৌঁছোয়, দুর্বল ভীরু নারীর কণ্ঠ সেখানে নীরব।
যাক শেষ পর্যন্ত ভারত হয়ে পাকিস্তানে এসে পৌঁছোলাম। এখন লায়েক খানের একমাসের ছুটি। এরপর সে জানতে পারবে কোথায় সে থাকবে। ইতোমধ্যে আমি বুঝতে পেরেছি আমি সন্তান সম্ভবা। আমার স্বামীও বুঝেছেন। আমাকে অভয় দিয়ে বললেন তার প্রথম স্ত্রী কখনও গাঁয়ের বাইরে আসবে না। তাই ও আমাকে সাথেই কর্মস্থলে রাখতে পারবে। এতোদিন ছিল নিজের চিন্তা এখন এই ক্ষুদ্র জীবের অস্তিত্ব আমাকে চঞ্চল করে তুললো। আমরা রাওয়ালপিন্ডিতে লায়েকের এক দোস্তের বাড়িতে উঠলাম। ওরা লোক খুব ভালো। আমাকে বেশ আদর করেই গ্রহণ করলেন। কোনও জিজ্ঞাসা কোনও সন্দেহ বা ইতস্ততভাব ওদের ভেতর দেখলাম না। লায়েক খান ওদের কাছে আমাকে দিন পনেরোর জন্যে রেখে দেশে গেল বিবি বাচ্চাকে দেখতে। আমি মনে মনে প্রমাদ গুণলাম। কিন্তু লাল খানের স্ত্রী আমাকে আশ্বাস দিয়ে বললেন-লায়েক খান অত্যন্ত পরহেজগার মানুষ। তাকে অবিশ্বাস করবার কোনও কারণ নেই। তাছাড়া পাঠানেরা কথার খেলাপ খুব কমই করে। ভাষা বুঝি না কারণ ভাঙা ভাঙা উর্দু বুঝলেও পোশতু আমার বোধগম্য হতো না তখন। ইশারা ইঙ্গিতে লাল খানের স্ত্রীর সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে গেল। প্রথম দর্শনেই ও বুঝতে পেরেছে আমি মা হতে চলেছি। বললো, আল্লাহ্ করুক, তোমার একটা মেয়ে হোক। দেখোনা, আমার দুটো ছেলে আমার কাছেও আসে না। বাপের সঙ্গে সঙ্গে অফিসে বাজারে গাঁয়ের খেতি খেলায় সব জায়গায় যায়। একটা মেয়ে থাকলে আমাকে ঘর গেরস্থালির কাজে কতো সাহায্য করতে পারতো, আমার সঙ্গে সঙ্গে তো ফিরতো। ভাবলাম নারীর দুর্ভাগ্যের কথা ও জানে না, তাই ও মেয়ে চায়। মেয়ে হলে আমি হয়ত গলা টিপেই মেরে ফেলবো। লায়েক খানের মুখেও শুধু মেয়ে মেয়ে। অবশ্য মেয়ের বিয়েতে ওরা টাকা পয়সা পায়, আর ওদের দেশে মেয়ের সংখ্যা কম তাই এতো কন্যাপ্রীতি।