ঠিক সন্ধ্যার আগে মৌলবী সাহেব নিকাহ পড়িয়ে দিলেন। তিনি এদেশীয় মনে হলো। বেশি কিছু পাওয়ায় খুব খুশি হয়েছেন। বললেন, ভালোই হলো তোর জন্যে, খান সাহেব ভালোমানুষ, তোকে ফেলবে না। পরদিনই ছোটাছুটি, চেঁচামেচি কিছু গুলির শব্দ। এদিক ওদিক লোকজন দৌড়োচ্ছে কিন্তু সিপাহীরা যার যার হাতিয়ার নিয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। আমি আমার স্বামীর কোমর ধরে ঝুলছি। কিন্তু কি আশ্চর্য! মানুষটা আমাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিল না। কে যেন লাউড স্পীকারে হুকুম দিলো, ওরা সব হাতিয়ার ফেলে দিলো যার যার পায়ের কাছে। কিছু মুক্তি বাহিনীর লোক, কিছু বিদেশী সিপাই মনে হলো। কারণ ওরা হিন্দিতে হুকুম করছিল। জানালো বন্দি মেয়েরা মুক্ত। ওদের অভিজ্ঞতা আছে তাই কিছু শাড়ি সঙ্গে এনেছে। সবাই পরে পরে যে যেদিকে পারলো ছুটলো।
আমি শাড়ি পরলাম কিন্তু লায়েক খানের হাত ছাড়লাম না। এতোক্ষণে বুঝলাম হিন্দী ভাষীরা ভারতীয় সৈন্য। একজন বললো, মা, তোমার ভয় নেই, তুমি বললে তোমাকে তোমার ঘরে পৌঁছে দেবো। আমার স্বামী করুণ নয়নে আমার দিকে তাকালো। আমি বললাম আমার কোনো ঘর নেই, ইনি আমার স্বামী। আমাদের ধর্মমতে বিয়ে হয়েছে। একে যেখানে নেবেন আমিও সেখানে যাবো। সেপাই হাসলো, পাকিস্তানি জওয়ানদের সঙ্গে আমাকেও বন্দি হিসেবে নিয়ে ট্রাকে তুললো। অফিসার একজনও ছিল না। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে সব পালিয়েছে। অবশ্য পরে শুনেছি পথে অনেকেই মুক্তিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে তাদের কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করেছে। তারা এই পশুদের কাছ থেকে যে অত্যাচার পেয়েছে তার প্রতিশোধ নিয়েছে নিমর্মভাবে। তবে ভারতীয় সৈন্যরা পেলে বন্দি করেছে, মারে নি কারণ যুদ্ধ যখন শেষ হয়ে গেছে, বন্দিকে ওরা মারবে না। এটা নাকি যুদ্ধের নীতি বিরুদ্ধ। জানি না সবই খানের কাছ থেকে শোনা কথা।
এবার আমাদের গন্তব্যস্থান সোজা ঢাকা সেনানিবাস। পথে আরও ট্রাক, জিপ চললো আমাদের সঙ্গে সঙ্গে। ঢাকায় ব্যারাকে পৌঁছোলাম। ওদের অফিসাররা সুন্দর সব বাড়িতেই আছে। আমাদের ব্যারাকেই রাখলো। কিন্তু হাবিলদার একটি আলাদা কামরা পেলো তার জরুর জন্য। আমি বেঁচে গেলাম। কেমন করে তাই ভাবছি।
লায়েক খানের শোকরানা নামাজ পড়া বেড়ে গেল কারণ ও ভাবতেও পারে নি যে জানে বাঁচবে। শুধু বার বার বলে আমার তকদীরে ও বেঁচে আছে। আর বেঁচে যখন আছে তখন দেশে একদিন না একদিন ফিরবেই আর বিবি বাচ্চার সঙ্গে দেখা হবেই। সব শুনে থেকে থেকে বুকটা কেঁপে ওঠে তাহলে আমাকে কোথাও ফেলে দেবে। ও আমাকে আশ্বাস দিলে মোসলমানের বাচ্চা যখন হাত ধরেছে তখন ফেলবে না। এটা তর্কের সময় নয়, কারণ উপস্থিত আমার সমূহ বিপদ। নইলে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল এ পর্যন্ত তোমরা কতজনের হাত ধরেছে আর ছুঁড়ে ফেলেছে। কিন্তু জিভ, ওই সব আমার এখন বন্ধ।
আমরা পৌঁছোবার পরদিনই আমাদের নাম-ঠিকানা লিখে নিয়ে গেল। আমাদের সঙ্গে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ কলেজের দু’জন উচ্চ শিক্ষিত মহিলা ছিলেন। এখানে প্রায় ত্রিশজন আমরা সব সময়েই একসঙ্গে থাকতাম ও শলাপরামর্শ করতাম। আপারা বললেন, নাম-ঠিকানা সব ঠিকঠাক মতো দিতে, দেশের লোক জানুক এ পশুরা আমাদের কি করেছে।
চারদিনের দিন বাবা এসে হাজির। আমাকে ডেকে নিয়ে একটা ঘরে বসালো। বাবা এলেন, একি চেহারা হয়েছে বাবার। জীর্ণ-শীর্ণ দেই। এই ক’মাসে অর্ধেক মাথা শাদা হয়ে গেছে। কয়েক সেকেন্ড দুজনেই নীরব রইলাম তারপর ছোটবেলার মতো দৌড়ে বাবার কোলে আছড়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ দু’জনেই শুধু কাঁদলাম। তারপর বাবার কাছে শুনলাম আমাকে নিয়ে যাবার প্রায় ঘন্টা দুই পরে বাবা আসেন। বড়ভাই আর আসে নি, ওখান থেকেই মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে চলে যায়। বাবা এসে লালুকে পাগলের মতো কাঁদতে দেখেন। মা ও মিলুকে হাসপাতালে নিয়ে যান। খোদার রহমতে মিলু ধীরে ধীরে ভালো হয়ে ওঠে কিন্তু মা হাসপাতালেই মারা যান। চোখ মুছে শোক ভুলে বাবাকে উঠে দাঁড়াতে হয়। অন্নের যোগাড় করতে নরসিংদীতে আসতে হয় দোকান চালাতে। শেষের দিকে দোকান প্রায়ই বন্ধ থাকতো। আমার কথা বলে অনেকে সহানুভূতি দেখাতো, অনেকে টিটকারী দিতো, আমি নাকি ইচ্ছে করে লাফিয়ে জিপে উঠেছি। যারা আমার সন্ধান দিয়েছিল তারাই বাবাকে বেশি নির্যাতন করেছে। কিন্তু ১৬ই ডিসেম্বরের মধ্যেই সব পালিয়েছে। বড়ভাই পাগলের মতো ওদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। সে আবার কি ঘটায় কে জানে। আমার দুচোখের পানিতে তখন আমার বুকের শাড়ি ভিজে গেছে।
বাবা বললেন, চল মা তোর নিজের ঘরে ফিরে চল। বড় দুর্বল হয়ে পড়লাম। মনে হলো বাবার সঙ্গে ছুটে যাই আমাদের সেই আনন্দময় গৃহে, যেখানে লালু, মিলু, বড় ভাই আজও আমার পথ চেয়ে আছে। কিন্তু না, এই মানুষটিকে আর আঘাত দিতে আমার মন চাইলো না। বাবাকে বললাম, তুমি ফিরে যাও, আমি এদের সঙ্গে ভালোভাবে কথা বলে দেখি। ওরা আমাদের জন্য কি ব্যবস্থা করবে। বাবা নাছোড়বান্দা। বললেন, আমি কারও কোনো অনুগ্রহ চাই না, তুই আমার মেয়ে আমার কাছেই থাকবি। যেমন এতো বছর ছিলি। অনেক কষ্টে সেদিন বাবাকে ফিরিয়েছিলাম। আমরা একসঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, শুধু পাকিস্তানি দস্যু নয়, নিজেদের দুর্বৃত্তদেরও চিনেছি এ দুর্দিনে। যারা আমাদের জায়গা দেবে তাদের অবস্থা কি দাঁড়াবে? নিজেরা তো মরেছি, ওরা তো এমনি মরে আছে, ওদের আর মেরে লাভ কি?