আমার জন্মস্থান ঢাকা শহরের কাছেই কাঁপাসিয়া গ্রামে। বাংলার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ঐ গ্রামেরই বীর সন্তান তাজউদ্দিন আহমদ ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী। এ কারণে ওই গ্রামের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধের ঘোরর সমর্থক। স্কুলে-পথে-ঘাটে আমাদের সবার মুখে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ কিন্তু জয়ের এ জোয়ার বেশিদিন স্থায়ী হলো না। এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে বিনামেঘে বজ্রপাত। হঠাৎ নরসিংদী বাজারে প্লেন থেকে গুলিবর্ষণ করে সমস্ত বাজারে আগুন ধরিয়ে দেয়া হলো। আমার বাবার ছোট্ট একটি দোকান ছিল ওই বাজারে। বাবা দর্জির কাজ করতেন। সঙ্গে ছিলেন দু’জন সহকর্মী! মোটামুটি যে আয় হতো তাতে আমাদের সংসার ভালোভাবেই চলে যাচ্ছিল এবং আমরা চার ভাইবোন সকলেই পড়াশোনা করছিলাম। এক ভাই কলেজে পড়ে, থাকে নরসিংদীতে বাবার সঙ্গে। আমি, মা, আমার ছোট দু’ভাই থাকতাম কাঁপাসিয়ায়! ধীরে ধীরে পরিবেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠতে লাগলো। আহত এবং পলাতক ইপিআর বাহিনীর সদস্যরা এ বাড়ি ও বাড়ি আশ্রয় গ্রহণ করতে থাকে। সম্ভবত এ সংবাদ গোপন ছিল না। তখনও প্রকাশ্যে রাজাকার বাহিনী আত্মপ্রকাশ করে নি। গোপনে সংবাদ আদান প্রদান চলছিল। একদিন হঠাৎ বিকেলের দিকে গ্রামে চিৎকার উঠলো মিলিটারি আসছে, মিলিটারি! মানুষজন দিশেহারা। সবাই নিজ নিজ বাড়ির উদ্দেশ্যে দৌড়োতে লাগলো। দেখতে দেখতে মনে হলো গ্রামের চারিদিকে আগুনে ছেয়ে গেছে। মাঝে মাঝে গুলির শব্দ। বাবা ও বড়ভাই নরসিংদীতে ওই আধপোড়া দোকানের মেরামতের কাজে ব্যস্ত। বাড়িতে আমি, মা ও ছোট দুই ভাই লালু আর মিলু। লালু গিয়েছে স্কুলের মাঠে ফুটবলখেলা দেখতে, এখনও ফেরে নি। মা ঘর বার করছেন।
এমন সময় একটা জলপাই রঙ-এর জিপ এসে বাড়ির সামনে বিকট আওয়াজ করে থামলো। মিলুকে বুকে জড়িয়ে ধরে আর আমার হাত ধরে মা শোবার ঘরে ঢুকলেন। কে যেন বাংলা বলছে, হ সাব, এইডাই মেহেরজানগো বাড়ি, বহুত খুব সুরত লেকী। আমার দেহ অবশ হয়ে আসছে। এমন সময় দরজায় লাথি। দ্বিতীয় লাথিতেই দরজা ভেঙে পড়লো। কয়েকজন লোক লুঙ্গিপরা ওদের সামনে। আমাদের টেনে বাইরে নিয়ে এল। ক্ষীণদেহে যথাসাধ্য বাধা দিতে চেষ্টা করলাম। চুল ধরে আমাকে জিপে তোলা হলো। মা আর্তনাদ করতেই মাকে ও মিনুকে লক্ষ্য করে ব্রাশফায়ার করলো শয়তানরা। আমাকে যখন টানা হেঁচড়া করছে দেখলাম মায়ের দেহটা তখনও থরথর করে কাঁপছে। গাড়ি স্টার্ট দেবার পর দেখলাম মিলুর মাথাটা হঠাৎ কাত হয়ে একদিকে ঢলে পড়লো। বুঝলাম মা ও মিলু চলে গেল। হঠাৎ করে আর্তনাদ করে উঠতেই ধমক খেলাম। ‘চোপ খানকী’ বোবা হয়ে গেলাম। আমাকে ঐ সম্বোধন করলো কি করে? আমি ভদ্রঘরের মেয়ে, অষ্টম শ্রেণীতে পড়ি। হঠাৎ কেমন যেন শক্ত কঠিন হয়ে গেলাম। আমার এই মানসিক স্থবিরতা কেটেছে অনেক দিন পরে। সেখান থেকে হাত ও জায়গা বদল হয়ে কখনও একা কখনও আরও মেয়েদের সঙ্গে ঘুরতে লাগলাম। মাঝখানে মনে হতো বাবা আর বড়ভাই বেঁচে আছে কি? লালু? লালু কি পালাতে পেরেছিল? আবার ভাবতাম কে বাবা, কে ভাই, লালুই বা কে আর আমিই-বা কে? নিজেকে একটা অশরীরী কঙ্কালসার পেত্নী বলে মনে হতো। কিন্তু তবুও এ দেহটার অব্যাহতি নেই! মাস দুই পর ওদের এদের নিজেদের প্রয়োজনে আমাদের গোসল করতে দিতো। পরনের জন্য পেতাম লুঙ্গি আর সার্ট কিম্বা গেঞ্জি, শাড়ি দেওয়া হতো না। ভাবতাম বাঙালির শাড়িকে ঘৃণা করলে আমাদের তো সালোয়ার কামিজ দিতে পারে। ময়মনসিংহ কলেজের এক আপাও ছিলেন আমাদের সঙ্গে। বললেন তা নয় শাড়ি বা দোপাত্তা জড়িয়ে নাকি কিছু বন্দি মেয়ে আত্মহত্যা করেছে তাই ও দুটোর কোনোটাই দেওয়া হবে না। তাছাড়া আমরা তো পোষা প্রাণী। ইচ্ছে হলে একদিন হয়ত এ লুঙ্গি সার্টও দেবে না। আপা নির্বিকার ভাবে কথাগুলো বললেন। দৃষ্টি উপরের দিকে অর্থাৎ ছাদের দিকে। উনি বেশির ভাগ সময়ই একা একা উপরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। মনে হতো যেন বাইরের আলো দেখবার জন্য ছিদ্র খুঁজছেন। কদিন পর আপা অসুস্থ হলো। সুয়ে থাকতো, ওকে শাড়ি পরিয়ে বাইরে নিয়ে যাওয়া হলো ডাক্তার দেখাবার জন্য। আপা আর ফিরলো না। ভাবলাম আপা বুঝি মুক্তি পেয়েছেন, অথবা হাসপাতালে আছেন। কিন্তু না, আমাদের এখানে এক বুড়ি মতো জমাদারণী ছিল, বললো, আপা গর্ভবতী হয়েছিল তাই ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। ভয়ে সমস্ত দেহটা কাঠ হয়ে গেল। এতে আপার অপরাধ কোথায়? আল্লাহ্ একি মুসিবতে তুমি আমাদের ফেললে। কি অপরাধ করেছি আমরা? কেন এই জানটা তুমি নিয়ে নিচ্ছো না? এখানেই চিন্তা থেমে যেতো।
কেন জানি না মরবার কথা ভাবতাম না। ভাবতাম দেশ স্বাধীন হবে আবার বাড়ি ফিরে যাবো। বাবা মা বড়ভাই লালু মিলু আবার আমরা সবো খেলবো গল্প করবো। কিন্তু আমি যে মাকে আর মিলুকে মরতে দেখে এসেছি। কিন্তু এমনও তো হতে পারে মিলিটারী গ্রাম থেকে চলে গেলে মাকে আর মিলুকে গ্রামের লোক বাঁচিয়ে তুলেছে, বাবাকে খবর দিয়েছে। হতেও তো পারে! ভাবনার আদি অন্ত ছিল না। দিন-রাতের ব্যবধানও ছিল শুধু শারীরিক অবস্থা ভেদে। প্রথম রাত্রি যেতো পশুদের অত্যাচারে, বাকি রাত দুঃখ কষ্ট মর্মপীড়া, দেহের যন্ত্রণা এ সব নিয়ে কতো ডেকেছি আল্লাহকে, হয়তো সে ডাক তিনি শুনেছেন, না হলে আজও বেঁচে আছি কি করে?